দেশের আদালতগুলোতে বর্তমানে ৪৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। অথচ বিচারকের সংখ্যা মাত্র দুই হাজারের কিছু বেশি। ফলে একজন বিচারককে একসঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার বিচার করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল ও অন্যান্য আদালতের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বও সামলাতে হচ্ছে। এই ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বের চাপের মধ্যে মামলাজট বেড়েই চলছে। এতে ভোগান্তি বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের।
মামলাজট কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার সাত শতাধিক নতুন বিচারকের পদ সৃজন করেছে। এসব বিচারক নিয়োগ পেলেই কি মামলাজট কমবে?
বিজ্ঞাপন
আইনজ্ঞরা বলছেন, মামলার সংখ্যার তুলনায় বিচারক স্বল্প হওয়ায় এতো অল্প সংখ্যক নিয়োগে জট কমানো খুবই কঠিন। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে, দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে কমপক্ষে ছয় হাজার বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।
মামলাজট কমাতে এবং বিচারকদের দায়িত্বের বোঝা কমাতে প্রথমবারের মতো পৃথক দায়রা (ফৌজদারি) ও পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত দায়রা আদালতের জন্য ২০৩টি, যুগ্ম দায়রা আদালতের জন্য ৩৬৭টি এবং পারিবারিক আদালতের জন্য ১৬৩টি পদ সৃজন করা হয়েছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে বিচার কাজে গতি আসবে এবং মামলার জট কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিচারিক আদালতগুলোতে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি আদালত পৃথক হওয়াই উচিত। কারণ আলাদা আলাদা বিচার করলে মামলাজট কমবে। সরকার যেহেতু ৭০০ নতুন পদ সৃষ্টি করেছে বিষয়টি আমরা পজিটিভ হিসেবেই দেখছি। তবে এর সঠিক ব্যবহার দরকার। ইচ্ছা থাকা দরকার।’
ছয় হাজার বিচারক নিয়োগে আইন কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত বড় নিয়োগ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। চাইলেই যেকোনো মুহূর্তে এত বড় একটা নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব না। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন এটি সুপারিশ করেছে। এখনো কোনো আইন তৈরি হয়নি। কাজেই আমি বলব, এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট আইন তৈরি হওয়া উচিত এবং বিচারক সংকট নিরসনে জোর দেওয়া উচিত।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পৃথক ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত এবং পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপনে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারক আলাদা করার দাবি বিচারকদের দীর্ঘদিনের। সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে বিচারকাজে গতি আসবে। বিচার বিভাগ সংস্কারে এটি হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এমন খবরে প্রথমে সাধুবাদ জানানো উচিত সরকারকে। তবে এসব পদে দক্ষ বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে মামলাজট কমানোর বিষয়টি আলোর মুখ দেখবে না। আর যদি ইনটেনশন খারাপ থাকে তাহলে কোনো উপকারই হবে না। যেমন বিচারক নিয়োগ দিয়ে বসে থাকল সরকার। নিয়োগের পর এগুলো মনিটরিং করতে হবে যথাযথভাবে।’
আরও পড়ুন: ৩৭ লাখ মামলার জট, উদ্যোগেও মিলছে না সুফল
মামলাজট কমাতে সুপ্রিম কোর্ট আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিচার বিভাগীয় রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের পাবলিক রিলেশন অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। এর আলোকে সরকার বিচারক নিয়োগে জুডিশিয়াল অ্যাপয়নমেন্ট কাউন্সিল গঠন করেছে। এই কাউন্সিল কার্যক্রম শুরু করেছে। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে মামলাজট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে।’
আইনি প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, দেওয়ানি মামলা বিচারের জন্য ‘দ্য সিভিল কোর্টস অ্যাক্ট-১৮৮৭’-এর ৩ ধারায় জেলা জজ আদালত, অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, যুগ্ম জেলা জজ আদালত, সিনিয়র সহকারী জজ আদালত এবং সহকারী জজ আদালত স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য ‘দ্যা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮’এর ৯ ধারায় দায়রা আদালত, অতিরিক্ত দায়রা আদালত, যুগ্ম দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য পৃথক পৃথক আদালত স্থাপনের উদ্দেশ্য আইনেই স্পষ্ট রয়েছে।
আরও পড়ুন: মামলাজট: বাস্তবতা ও উত্তরণের উপায়
তবে যুগ যুগ ধরে অধস্তন আদালতের বিচারকরা একসঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা দেখেছেন। সহকারী ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতগুলোও পারিবারিক আদালতের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে দেওয়ানি ও পারিবারিক মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।
গত মে পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৩৪ হাজার ৩৪২টি দেওয়ানি এবং ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭২টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন ছিল। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১ লাখ ৮২ হাজার ৮৩২টি দেওয়ানি এবং ৩ হাজার ৫৫৭টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন ছিল। সহকারী ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ৯ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯টি দেওয়ানি এবং ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৩০টি পারিবারিক মামলা বিচারাধীন ছিল।
পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩-এর ৪ ধারায় প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক স্বতন্ত্র পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ আদালতগুলোকে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব এবং সন্তানের হেফাজত সম্পর্কিত বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কাজ করে। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও এতদিন দেশে কোনো পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
দেওয়ানি আদালতগুলোতে বিচারাধীন অসংখ্য মামলার বিচারের পাশাপাশি সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতগুলোকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পারিবারিক আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে। ফলে দেওয়ানি মামলার বিচার যেমন বিলম্ব হচ্ছে, তেমনি পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো গুরুত্ব সহকারে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে বিচার প্রার্থীদের দুর্ভোগ কমানো ও ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিষয়টি লক্ষ্য করে গত ২১ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। চিঠিতে বলা হয়, অধস্তন আদালতগুলোতে বর্তমানে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ দেওয়ানি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
এর ফলে বিচারকদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে মামলার জট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: মামলার জট কমাতে সরকারি উদ্যোগে আশার আলো
চিঠিতে আরও বলা হয়, পৃথক এখতিয়ার প্রয়োগের সুবিধার্থে এবং মামলাজট নিরসনের জন্য বিচার বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে পৃথক আদালত স্থাপন ও দরকারি সংখ্যক পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি এখতিয়ার অনুযায়ী জেলা জজশিপ ও সেশনস ডিভিশন পৃথককরণ এবং প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করতে।
প্রধান বিচারপতির চিঠির পাশাপাশি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সক্রিয় ভূমিকার কারণে দায়রা আদালতের পাশাপাশি পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপন ও পদসৃজনের কাজেও গতি পায়। এছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রতি ৮০০ মামলার বিপরীতে একজন বিচারক প্রয়োজন-মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি মামলাজট নিরসন ও বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশসহ ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করে কমিশন।
এতে মামলাজট নিরসনের বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এতে পুরনো মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে নতুন কোনো সুপারিশ উঠে আসেনি। প্রতিবেদনে অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা ছয় হাজারে উন্নীত করার তাগিদ দেওয়া হয়।
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও জট কমিয়ে আনতে ২০২৩ সালের আগস্টে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদন দাখিল করে আইন কমিশন। সেখানে মামলাজটের কারণ হিসেবে পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, জনবলের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এছাড়াও প্রতিবেদনে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে চার বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ এবং আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয়। ২০১২ সালেও মামলাজট নিরসনে ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধিসহ পুরোনো আইনগুলো সংশোধন, পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের উদাসীনতায় অধিকাংশ সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
এআইএম/এমআর
