বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

৩৭ লাখ মামলার জট, উদ্যোগেও মিলছে না সুফল

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ২১ মে ২০২২, ১০:২৫ পিএম

শেয়ার করুন:

৩৭ লাখ মামলার জট, উদ্যোগেও মিলছে না সুফল

বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৭ লাখ মামলা বিচারাধীন। পাহাড়সহ এসব মামলার তুলনায় বিচারক সংখ্যা খুবই কম। সবমিলিয়ে বিচারক রয়েছেন প্রায় দুই হাজার ১০০ জন। রাতদিন পরিশ্রম করেও মামলার স্তুপ সরাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে মামলার জট কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে নানা কারণে এই উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া না মেনে ঠুনকো অভিযোগেই মামলা হচ্ছে দিনের পর দিন। সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনায় মামলা তো আছেই। ঘটনার যাচাই-বাছাই না করে মামলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জট শুধু বাড়ছেই।

এদিকে মামলার মেরিট ও আইনি যৌক্তিকতা না থাকার পরেও সুপ্রিম কোর্টের দিকে দৌড় দিচ্ছেন অনেকেই। আবার যুক্তি ছাড়া জনস্বার্থের নামেও করা হচ্ছে শত শত রিট। এসব ঘটনায় বিরক্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট অনেককেই জরিমানাও করছেন আদালত। তারপরেও মামলা করা হচ্ছে দেদারছে।

মামলার জট প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, মামলাজট নিরসনে মূল সমস্যা হলো বিচারক সংকট। সিস্টেমের দুর্বলতা। কথায় কথায় মানুষের মামলা করার প্রবণতা। যেকোনো ছোট-খাটো বিষয়ে ঝামেলা হলেই এখন মানুষ হাইকোর্টে আসে। মামলা চলবে কি না সেটি বাছাই না করে হাইকোর্টে চলে আসে মানুষ। গ্রাউন্ড দেখে মামলা করা উচিত।

বিচারকদের কাজে অলসতা নেই উল্লেখ করে এই আইনজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশের বিচারকরা যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। সকাল সাড়ে দশটা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিচারিক কাজ করেন। দুপুরে এক ঘণ্টার বিরতির পর আবারও তারা কাজে মনোযোগ দেন। কাজের দিক থেকে তারা কম করেন না। আসলে আমাদের দেশে মামলার ফাইল হয় বেশি। মামলা জট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে বেশি করে। বিচারকসংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলে সমস্যার সমাধান হবে।

মামলার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইল বলেন, আমাদের দেশে মামলার বিচারিক ধাপ বেশি। পৃথিবীর কোনো দেশে এরকম প্রক্রিয়া নেই। সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ, যুগ্ম জেলা জজ, জেলা জজ, হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ, মামলার রায়ের রিভিউ। এতগুলো ধাপ পার করতে যুগ যুগ সময় লেগে যায় মামলা নিষ্পত্তি করতে। পৃথিবীর কোথাও নেই এত ট্রায়াল (বিচার)। বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতি আমাদের দেশে খুব একটা কাজ দেয় না। এডিআর বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সিস্টেমের কারণে মামলা জট কমছে না। কারণ এডিআরের সিদ্ধান্ত ম্যান্ডাটোরি (বাধ্যতামূলক) না। এডিআরের পরেও বিচারপ্রার্থীরা কোর্টে ফিরে আসতে পারেন।

01

ওই বিচারপতি বলেন, আমাদের দেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশের মামলা জট এত বেশি না। বিদেশের হাইকোর্টের বিচারকরা সপ্তাহে সর্বোচ্চ এক থেকে দুইটা মামলা শুনেন। আর আমাদের এখানে দিনে শোনেন শতাধিক মামলা। এটি অমানবিক। কোর্টের বাইরে বাসাতেও বিচারকদের কাজ করতে হয়। বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করেন তারা।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মো. অজি উল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের দেশের মামলা জটের প্রবণতা বেড়েছে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে মানুষ ন্যায়বিচার পেতে আদালতে যাচ্ছে। মামলা করছে। মামলা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, এজন্য মামলাজট বাড়ছে।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জনস্বার্থের মামলার দরজাটা যখন ওপেন হয়েছে তখন থেকেই আমি বলে আসছি এর মধ্যে দিয়ে জনস্বার্থবিরোধী কাজকর্ম হতে পারে। এ ব্যাপারে আদালতকে সচেতন হতে হবে। আমরা গত কয়েক বছর ধরে বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অনেক জনস্বার্থের মামলায় এখানে ব্যক্তিস্বার্থ ঢুকছে। আবার অনেকেই জনস্বার্থের মামলা পাবলিসিটি মামলা হিসেবে নিচ্ছেন। অনেক আইনজীবী জনস্বার্থের মামলা নামে লিগ্যাল নোটিশ দিচ্ছেন। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় নিউজ আসার পর আর কোনো মামলা করছেন না। অনেকে রিট পিটিশন ফাইল করছেন, কিন্তু শুনানি করছেন না। যেহেতু এগুলো গ্রহণযোগ্যতা নাই তাই এগুলো আদালত তো খারিজ করবেই। এজন্য মামলাকারীরা শুনানির উদ্যোগ নেন না।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আদালত দুই একজনকে ফাইনও করেছে। তারপরেও এটি কমছে না। কারণ এই মামলাগুলো করলে পাবলিসিটি পাওয়া যায়। এটা নিয়ে মিডিয়ারও দায়িত্ব আছে। সব মামলা কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে না। সবাই যদি সচেতন হয় তাহলে এর প্রভাব পড়বে। কারণ এসব মামলা করাই হচ্ছে প্রচারের জন্য। জনস্বার্থের নামে এসব মামলা করা হচ্ছে প্রচারের জন্য আদালতের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য। জনস্বার্থের মামলা যেন কোনোভাবেই ব্যক্তি স্বার্থে বা প্রচারের জন্য না করা হয়।’

বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ ৮৫ লাখ মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই মিথ্যা ও যড়যন্ত্রমূলক। আর এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ নেতাকর্মীকে। দেশের আদালত পাড়ায় মামলা জট হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ।’

02

মামলাজট কমাতে সরকার মহতি উদ্যোগ নিয়েছে এমন দাবি করে আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা ড. রেজাউল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, মামলাজট কমাতে সরকার ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করেছে। বিচারকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) চালু করেছে)

জনস্বার্থের নামে রিট করার ঘটনায় ইতোমধ্যে একাধিক আইনজীবীকে জরিমানাও করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ জনস্বার্থের নামে মামলা করে সময় নষ্টের কারণে একজন সিনিয়র আইনজীবীকে জরিমানা করেছেন। তিনি জনস্বার্থের নামে মাঝেমধ্যেই মামলা করেন। এসব মামলার বেশিরভাগ খারিজ করে দেন আদালত। কারণ তার মামলায় আইনগত ভিত্তি না থাকায় মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, এসব মামলায় আদালতের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হচ্ছে।

এদিকে মামলাজট ও বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি কমাতে ধাপে ধাপে বিচারক নিয়োগ করা হচ্ছে দেশের সব আদালতে। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে বর্তমানে মোট ৯৩ জন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে আপিল বিভাগে রয়েছেন ৭ জন। হাইকোর্ট বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন ৮৬ জন। এছাড়া নিম্ন আদালতে দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় এক হাজার ৯৫০ বিচারক। নতুন করে সহকারী জজ পদে ১০২ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। 

এআইএম/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর