শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে বিচার বিভাগকে নজিরবিহীন দলীয়করণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু নিম্ন আদালত নয়, উচ্চ আদালতেও বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার মসনদে টিকিয়ে রাখার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ‘দলদাস’ বিচারকরা। ফলে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগের নিয়োগকৃত চিহ্নিত বিচারকদের অপসারণের দাবি ওঠে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে একযোগে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচরণ এবং দুর্নীতির নানা অভিযোগও রয়েছে। ফলে পর্যায়ক্রমে তাদের কেউ পদত্যাগ করেছেন। কাউকে কাউকে অপসারণ করা হয়েছে। সেই ১২ বিচারপতির মধ্যে আটজনের পদত্যাগ, অপসারণ ও অবসরের পর এখনো চারজন বিচারপতির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
বিজ্ঞাপন
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। পতন ঘটে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের। এর মাস-দুয়েক পর ১৫ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে ‘দলবাজ, দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টের দোসর’ বিচারকদের পদত্যাগের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম। ১৬ অক্টোবর দুপুরে মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট চত্বরে আসেন শিক্ষার্থীরা। সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের নেতৃত্বে দক্ষিণ গেট দিয়ে ঢুকে তারা হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেন।
আদালত প্রাঙ্গণে হাসনাত-সারজিসসহ অন্য শিক্ষার্থীদের নানা স্লোগান দিতে শোনা যায়। আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ। এর সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের ‘দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকে বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ। এই কর্মসূচি চলার মধ্যেই বেশ কয়েকজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
আলোচনার পর ১৬ অক্টোবর বিকেলে ছাত্রদের সামনে এসে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি। তাদের পদত্যাগ বা অপসারণ; সেই উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে হয়ে থাকে। এখানে প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয় উনি সেটা করেছেন। আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেওয়ার অর্থ হলো, আগামী ২০ (অক্টোবর) তারিখ যে কোর্ট খুলবে, তারা বিচার কাজে অংশ নিতে পারবেন না।
বিজ্ঞাপন
পরে বিচারপতিদের অপসারণসংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহালের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কার্যক্রম শুরু করে। অপর দুজন হলেন, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী।
কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এই কাউন্সিল যাচাই বাচাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ পাঠান। সংবিধান অনুসারে, প্রধান বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ দুইজন বিচারপতির সমন্বয়ে এ কাউন্সিল গঠিত হয়। এরপর কয়েকজন বিচারপতির আচরণের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে কাউন্সিল।
এ অবস্থায় দীর্ঘদিন বিচার কাজের বাইরে থাকা (বেঞ্চ না পাওয়া) তিন বিচারপতি ১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। তারা হলেন, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে জানানো হয়, হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাদের বিচারকার্য থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয়েছে। সেই থেকে তারা আর বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারেননি।
১২ বিচারপতির সর্বশেষ তথ্য
গত ৩০ জানুয়ারি বিচারপতি সাহেদ নূরউদ্দিন পদত্যাগ করেন। এছাড়া দুইজন বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাননি। তারা হলেন, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলন। অপর দুই বিচারপতি এরইমধ্যে অবসর গ্রহণ করেছেন। তারা হলেন, বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস।
আরও পড়ুন
খায়রুল হকের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান আওয়ামীপন্থীরাও!
আওয়ামী লীগের ‘সুবিধাভোগী’ আইনজীবীরা আদালতে অনুপস্থিত কেন?
আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর দুই বিচারপতিকে অপসারণ করেন রাষ্ট্রপতি। তারা হলেন বিচারপতি খিজির হায়াত ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান।
বাকি পাঁচজনের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্ত চলমান রয়েছে।
এই পাঁচ বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে গত ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে নির্দেশনা দেন। ১ জুলাই কাউন্সিলের সামনে হাজির হয়ে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান। এর ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানের বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানির দিন ধার্য করেন। এর মধ্যেই রোববার (৩১ আগস্ট) তিনি পদত্যাগ করেন।
বাকি চারজনের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তাদের বিষয়েও শিগগির সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এআইএম/জেবি

