গৃহিনী লায়লা বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন বিধবা ছিলেন। পরে বিয়ে করেন ফারুক মিয়া নামের একজনকে। কিন্তু তার সঙ্গে বনিবনা হয়নি। তার কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে ফারুক পালিয়ে যান। পরে মামলা করেন ঢাকার একটি আদালতে। যৌতুক নিরোধ আইনের মামলাটিতে আদালত প্রথমে সমন জারি করেন। এরপর ওয়ারেন্ট এবং ধাপে ধাপে মামলাটির কার্যক্রম এগোনোর কথা। কিন্তু কোনো এক কারণে গ্রেফতারি পরোয়ানার কপি আটকে যায়।
তখন লায়লা শরণাপন্ন হন আদালতের জনৈক কর্মচারীর। কিন্তু ওই কর্মচারী গড়িমসি করতে থাকেন। বিভিন্ন অজুহাতে দফায় দফায় বকশিশের নামে হাতিয়ে নেন অর্থ। এক পর্যায়ে পরোয়ানার কপি পাঠানও। কিন্তু বিলম্বের কারণে ততদিনে আসামি ফারুক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
বিজ্ঞাপন
ঘটনাস্থল ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বিএনপি কর্মী স্বপনের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা করে পুলিশ। সে মামলায় জামিন নিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছিলেন তিনি। এক তারিখে মিস করায় জামিন বাতিল করে স্বপনকে কারাগারে পাঠান বিচারক। আইনজীবী নিয়োগ করে আবার তার জামিন করান স্বজনরা। কিন্তু কথিত বকশিশের টাকা কম দেওয়ায় পুলিশের জিআরও শাখায় আটকে যায় তার জামিন আদেশের কপি। পরে টেবিলে টেবিলে ঘুরে, বকশিশের নামে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে জিআরও থেকে আদেশের কপি পৌঁছানো হয় কারাগারে। জামিনের পরও কয়েক দিন অতিরিক্ত জেল খেটে বের হতে হয় স্বপনকে।
শুধু লায়লা কিংবা স্বপনই নয়, ঢাকার নিম্ন আদালতে এমন ভোগান্তির শিকার হাজার হাজার মানুষ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, বিচারালয়সহ নানা অঙ্গনে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। কিন্তু আদালতপাড়ায় বকশিশের নামে উৎকোচের মহোৎসব সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। যেকোনো একটি মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে বকশিশের নামে দিতে হয় উৎকোচ। মামলাভেদে বকশিশের পরিমাণ ১০০ থেকে লাখ টাকায় ওঠানামা করে।
জরিপে দেখা গেছে, দেশের ১৩টি সেবা খাতের মধ্যে বিচার বিভাগে সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটে। ঘুষ ছাড়া যেন এখানে কোনো কাজই হয় না। যদিও এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এটাকে ঘুষ বলতে নারাজ। তারা এটাকে বকশিশ বলে থাকেন। আর এর মধ্য দিয়ে দিনের পর দিন মানুষের পকেট কাটছে একটি অসাধু চক্র।
ঢাকার আদালতে পদে পদে অনিয়ম, ভোগান্তি
দেশের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মামলা বিচারাধীন ঢাকার আদালতগুলোতে। কিন্তু এই আদালতের ব্যবস্থাপনা বিচারপ্রার্থী বান্ধব হয়ে ওঠেনি এখনও। এখানে মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেওয়া, ওকালতনামায় স্বাক্ষর করা, জামিননামা দেওয়া, মামলা লিস্টে আনা, শুনানির সিরিয়াল মেনটেইন করা, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলাসংক্রান্ত যেকোনো সেবা নিতে গুনতে হয় অর্থ। এছাড়াও পত্রিকাতে পলাতক আসামির বিজ্ঞপ্তি, নিলাম জারি ও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশেও সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন প্রতিনিধিদের থেকে বকশিশ বা খরচাপাতির নামে নেওয়া হয় উৎকোচ।
ভুক্তভোগী এবং আইনজীবীরা বলছেন, এই সমস্যা দূরীকরণে গোয়েন্দা ইউনিটকে কাজে লাগানো যেতে পারে। গোয়েন্দারা ঘুরে ঘুরে এসব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে পারে। এতে কিছুটা কমতে পারে ভোগান্তি।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিম্ন আদালতে অনিয়মের চিহ্নিত স্থানগুলো হলো ফাইলিং শাখা, সেরেস্তা, জিআর শাখা, আদালতের পেশকার, উমেদার, মামলার জিআরও, ইস্টেনোগ্রাফার (আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর), বিচারকদের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডেসপাস শাখা। এসব জায়গায় বেশির ভাগ কর্মচারী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগতিতে। আদালতে দেওয়া ঘুষের এই টাকাকে তারা বলে খরচাপাতি। তবে ঘুষের এই খরচাপাতিকে আদালতের উকিল, মুহুরি, পিয়ন, পেশকার ও পুলিশ কেউই ‘ঘুষ’ বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য- নির্বিঘে কাজ শেষ করতে ‘বকশিশ’ দিতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিয়ন, পেশকার, উমেদার ও কনস্টেবলদের আছে অত্যন্ত শক্তিশালী আন্তঃআদালত নেটওয়ার্ক। ফলে সব আদালতের চিত্র প্রায় একই রকম। এমনকি তারা অর্থের বিনিময়ে নথি গুম করে রাখে। নথি খুঁজে না পাওয়ায় অনেকে নারাজি দাখিল কিংবা রিভিশন বা রিভিউ আবেদন করতে পারেন না। একপক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অন্য পক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই এসব করা হয়ে থাকে।
আবার কখনো কোনো পক্ষের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তারা হাজির আছে মর্মে নথিতে উল্লেখ করে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নথি থেকে সময়ের আবেদন সরিয়ে ফেলে হাজিরা দেখিয়ে দেয় আদেশের মধ্যে।
এছাড়া ভুয়া বাদী সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলায় আইনজীবীর বিকৃত সিল দেওয়া, হাজিরা, ওকালতনামা ও পিটিশন গ্রহণ করা, এমনকি আসামি বদল করে অন্য আসামি দিয়ে জেল খাটানোর নজিরও আছে ঢাকার নিম্ন আদালতে।
কী বলছেন আইনজীবীরা
ঢাকা জজ কোর্টে ২২ বছর ধরে উকালতি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম এ জলিল উজ্জ্বল। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার পেশা জীবনের শুরু থেকেই দেখে আসছি আদালত অঙ্গনে পিয়ন-পেশকার, উমেদার-পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বকশিশের নামে ঘুষ নিয়ে থাকেন। এটা এখনকার কালচার। ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত। প্রায় প্রত্যেকটি জায়গায় দিতে হয় বকশিশের নামে ঘুষ। না দিলে তারা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করেন না। নাক ছিটকানো ভাব দেখান।
এম এ জলিল উজ্জ্বল বলেন, মামলাভেদে এই বকশিশের পরিমাণ ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয় আইনজীবীসহ মক্কেলদের। এই টাকাটা না দেওয়ার কারণে অনেক সময় ভোগান্তির শিকার হন তারা। বিপাকে পড়েন আইনজীবীরাও। কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকে না। কারণ টাকাটা না দিলে তারা সময়ের সঠিক কাজগুলো থেকে বিরত থাকেন বা অনীহা প্রকাশ করেন কাজের ক্ষেত্রে। আদালতপাড়ার এই বকশিশ কালচারের কারণে অনেকে ভোগান্তির শিকার হন।
এই আইনজীবী আরও বলেন, এই বকশিশ প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটি করতে হলে বিচার বিভাগের উচিত একটি আলাদা গোয়েন্দা শাখা তৈরি করা। যাতে করে গোয়েন্দারা ঘুরে ঘুরে এই খবরগুলো নিতে পারেন। উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করলে হয়ত এই ভোগান্তি থেকে আমরা মুক্তি পাব।
তবে বকশিশের নামে ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে সেটির বিচার হয় বলে জানান পরিবেশ আপিল আদালতের পিপি রায়হান মোর্শেদ। এই আইনজীবী ঢাকা মেইলকে বলেন, অনেক সময় শুনে থাকি যে, আদালতের কর্মচারী-কর্মকর্তাসহ অনেকেই বকশিশের নামে টাকা দিতে হয়। কিন্তু এগুলো যদি লিখিত আকারে কেউ অভিযোগ করেন বা অভিযোগ দেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। কেউ যদি অভিযোগ দাখিল না করে বা লিখিত আকারে কিছু না দেয় সে ক্ষেত্রে তো কিছু করার থাকে না। আমরাও চাই বিচারপ্রার্থী যেন হয়রানি শিকার না হন, তিনি যেন আদালতে ন্যায়বিচার পান।
এআইএম/জেবি