‘অন্যায়ভাবে গুলি করে আমাকে পঙ্গু করা হলো। পা কেটে ফেললাম। সন্ত্রাসী বানাতে উল্টো মামলা খেলাম, কিন্তু কেন? যে বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব, সেই বয়সে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছি ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য। আমি তো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না, সন্ত্রাসীও না, তাহলে কেন আমি বিচার পাচ্ছি না। বিগত ১৩ বছর আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে আমাকে। নানাভাবে আমি ও আমার পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
কান্নারত অবস্থায় ঢাকা মেইলের কাছে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন র্যাবের গুলিতে পা হারানো যুবক লিমন হোসেন। বিগত হাসিনা সরকারের আমলে বিচার না পেয়ে উল্টো মামলা খেয়েছেন এই যুবক। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সেই আমলের অবসান হয়েছে। তাই সুবিচারের আশায় বুক বেঁধেছেন তিনি। ন্যায়বিচারের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ পাবেন এমন প্রত্যাশায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়েছেন লিমন হোসেন।
বিজ্ঞাপন
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বিচার চেয়ে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছেন লিমন। পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের প্রতি তার ক্ষোভের শেষ নেই। কালো পোশাকের এই বাহিনীকে তিনি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে দেখেন। এজন্য চেয়েছেন র্যাবের বিলুপ্তি।
লিমন হোসেন তার ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘যে সময়টা আমার আনন্দ করার কথা, খেলাধুলা করার কথা, সে সময় আমার পা হারাতে হয়েছে। আমি আমার ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা সরকারের অসহযোগিতায় র্যাবের গুলিতে ১৩ বছর আগে পা হারানোর ঘটনায় বিচার পাননি বলে অভিযোগ করেন লিমন হোসেন। এই ১৩ বছর ধরে তদন্তের নামে সরকার প্রহসন করেছে বলেও অভিযোগ তার।
বিজ্ঞাপন
তাকে হত্যাচেষ্টায় র্যাবের তৎকালীন আরও তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন অভিযোগ করে তাদেরসহ র্যাবের নয় সদস্যের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন লিমন।
২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বরিশাল র্যাব-৮ এর সদস্যরা লিমনকে গুলি করেন। ওই ঘটনায় লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। সেই মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
এ মামলায় তৎকালীন র্যাব-৮ এর উপ-সহকারী পরিচালক লুৎফর রহমান, করপোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. আব্দুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহ্লাদ চন্দ এবং কার্তিক কুমার বিশ্বাসসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন র্যাব সদস্য আসামি হন।
ওই সময় র্যাবের ভাষ্য ছিল, র্যাব একটি অভিযান চালানোর সময় কিশোর লিমন গুলিবিদ্ধ হন। তবে লিমন বলছেন, সেদিন র্যাবের সদস্যরা তার শার্টের কলারে ধরে বাম পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। একই সঙ্গে তাকে সন্ত্রাসী বানাতে দুটি মিথ্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছিল।
সেই দিনের কথা স্মরণ করে লিমন হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১১ সালে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারের সন্ত্রাসী র্যাব বাহিনী দ্বারা আমি নির্যাতিত হয়েছিলাম, নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমার শার্টের কলারে ধরে পায়ে গুলি করে। এর ফলে আমার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করি।’
লিমন বলেন, ‘এই ১৩ বছর বহু চেষ্টা করেছি, অনেক আকুতি-মিনতি করেছিলাম ন্যায়বিচারের জন্য। গত ১৩ বছর তদন্তের নামে একটা প্রহসন করে গেছে আওয়ামী সরকার।’
লিমনকে হত্যাচেষ্টার মামলাটি প্রথমে পুলিশ তদন্ত করে। পরে ডিবি হয়ে পিবিআই তদন্ত করে। এখন সিআইডির কাছে এটি তদন্তের দায়িত্ব রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিআইডি এখন পর্যন্ত তদন্ত শুরুই করতে পারেনি। রাষ্ট্রের কাছে আমি জানতে চাই, একটা মামলার তদন্ত করতে আসলে কত বছর সময় লাগার কথা? বার বার একটা কথাই বলে, লিমনকে র্যাব গুলি করেনি। তাহলে কে গুলি করেছে? তোমরা এটা খুঁজে বের করো ভাই।’
আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে ন্যায়বিচার পাননি জানিয়ে লিমন বলেন, ‘বরং বিচার চেয়ে আমাদের পরিবার অনেক হয়রানির শিকার হয়েছে। র্যাবের বিরুদ্ধে আমার মা মামলা করায় আমি এবং আমার পরিবার ৮/১০ বছর গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারিনি। পার্শ্ববর্তী জেলা পিরোজপুরে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়েছে।’
র্যাব অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে লিমনের বিরুদ্ধে পাল্টা দুটি মামলা করেছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পা কাটার পরও এক পা নিয়ে কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় হাজিরা দিতে হয়েছে। আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের হয়রানি করেছে এই র্যাব।’
২০১৩ সালে দুটি মামলা থেকেই খালাস পান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখান থেকেই প্রমাণ হয় আমি নির্দোষ ছিলাম। এই খালাসের বিরুদ্ধে র্যাব আপিলও করেনি।’
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতার আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানুষের মধ্যে একটা আস্থা ও ভালোবাসার জায়গা হয়েছে মন্তব্য করে লিমন হোসেন বলেন, ‘আমি এই ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়েছি ন্যায়বিচারের জন্য। দ্রুত বিচার পাওয়ার আশায় ট্রাইব্যুনাল ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আমার মামলার বিচার করতে পারলে দেশে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত হবে।’
শেখ হাসিনা সরকারের সময়কে ‘ফ্যাসিবাদের শাসনামল’ উল্লেখ করে ওই সময় র্যাবের ‘অপরাধী’ সবাইকে মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন লিমন। বলেন, ‘জড়িত সবাইকে আমরা আসামি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নানা বাধা-বিপত্তি ছিল, অনেক রকমের হুমকি-ধমকি ছিল, তাই কয়েকজনকে আসামি করতে পারিনি।’
তৎকালীন র্যাব-৮ এর প্রধান মেজর রাশেদ, র্যাবের সহকারী মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান ও শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম কোনোভাবেই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি বলে জানান তিনি। লিমন বলেন, ‘আজকে ট্রাইব্যুনালে এই তিনজনের নামও অন্তর্ভুক্ত করে মোট নযজনের নামে অভিযোগ দিয়েছি। তারা সবাই র্যাবের সদস্য।’
পঙ্গু হাসপাতালের প্রিজন সেলে পা কাটা অবস্থায় পুলিশ সব সময় পাহারা দিয়ে রাখত জানিয়ে লিমন বলেন, ‘মনে হচ্ছে আমি কত বড় সন্ত্রাসী ছিলাম। শুধু র্যাব না, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, উনি হাসপাতালে ফোন করে বলেন, আমাকে যেন সেখানে চিকিৎসা দেওয়া না হয়। এরপর অসুস্থ অবস্থায় আমাকে জেলে নিয়ে যায়। পরে আমি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে আমার চিকিৎসা করাবে না বলে দেয়।’
ওই সময় লিমনের চিকিৎসার দায়ভার রাষ্ট্রকে নিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশও রাষ্ট্র তখন মানেনি। রাষ্ট্র নিজেকে মনে করতো সবকিছুর ঊর্ধ্বে।’
পা হারানো এবং পরবর্তী সময়ে মিথ্যা মামলাসহ হয়রানির ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে দেওয়া অভিযোগে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে বলে জানান লিমন।
এআইএম/জেবি