রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সর্বোচ্চ আদালতের অনুশাসন মানছে না ‍পুলিশ!

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

police-court

‘বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না’ উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা মানছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে হর-হামেশাই চলছে পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য। রাজনৈতিক দলের কর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনা উচ্চ আদালতের নজরে এসেছে এবং ক্ষোভও জানিয়েছেন হাইকোর্ট।

আইনজ্ঞরা বলছেন, এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে দেশের আইন-আদালতকে অপমান-অপদস্ত ও নিচু করা হবে। লঙ্ঘিত হবে সাধারণ নাগরিকের মানবাধিকার, যা সরাসরি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ৩৫ লাখ মামলা নিষ্পত্তিতে ২ হাজার বিচারক!

সম্প্রতি এ ধরনের দুটি ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে পুলিশের ওপর চটেছেন হাইকোর্ট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি একটি অনুশাসনও দিয়েছেন উচ্চ আদালত। আসামি গ্রেফতার করতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বলেছেন হাইকোর্ট।

রায়ে আদালত বলেন, ‘এখন থেকে যে কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ মানতে হবে।’ সংবিধানের সেই অনুচ্ছেদে রয়েছে- ‘জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ তবে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


‘পুলিশ এত ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পায় কোথায়?’

আদালতের জামিন আদেশের পরেও শরীয়তপুরের ছিনতাইয়ের একটি মামলায় আসামিদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে নির্যাতন ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে আগামী ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টের রায় ঘোষণার কথা রয়েছে।

এই মামলার শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন- ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালো কাজ করছে। দু’একজন সদস্যের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো বাহিনীকে দায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর দু’একজন সদস্যের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দুর্নামের ভাগিদার হতে হয় সরকারকে।’

আরও পড়ুন: মিনিটে ২৪টি মামলা নিষ্পত্তি!

আদালত আরও বলেন, ‘আমরা আসামিদের আগাম জামিন দিয়েছি। সেই জামিনের ল’ইয়ার সার্টিফিকেটও ছিঁড়ে ফেলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। শুধু ছিঁড়েই ফেলেননি, আসামিদের গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছেন। এমনকি রিমান্ডের আবেদন দিয়েছেন। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেফতার করে নির্যাতন করেছেন।’ এমন বাস্তবতায় আদালত বলেন- ‘পুলিশ এত ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পায় কোথায়?’

এর আগে এই মামলায় হাইকোর্টের তলবে হাজিরা দেন শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল ইমরান। শরীয়তপুরের ওই ঘটনায় তাকে আদালতের নানা জিজ্ঞাসার জবাব দিতে হয়। এক পর্যায়ে হাইকোর্ট বলেন, পুলিশ শ্যোন অ্যারেস্টের আবেদন দিলেই আপনি সেটা মঞ্জুর করবেন, তাহলে বিচারক হয়েছেন কেন? আপনাকে জুডিশিয়াল মাইন্ড প্রয়োগ করতে হবে। মামলার নথিপত্র দেখে তবেই আদেশ দিতে হবে।

শুনানিকালে আদালতে নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান হাজিরা দেন। তাদের দুজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করেছে পুলিশ প্রশাসন।

জামিনের পরও শিক্ষার্থী গ্রেফতার, ক্ষমা চাইলেন দুই পুলিশ

এদিকে জামিনে থাকার পরও কলেজ শিক্ষার্থী আশরাফুল হাওলাদারকে গ্রেফতারের ঘটনায় পটুয়াখালী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মিজানুর রহমান হাইকোর্টে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে তাদের ক্ষমা করে দেন আদালত।

আগাম জামিনে থাকার পরও কলেজ শিক্ষার্থী আশফুল হাওলাদারকে গ্রেফতারের ঘটনা নজরে আনলে গত ২০ মে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন। আদেশে মনিরুজ্জামান ও মিজানুর রহমানকে তলব করা হয়। জামিনে থাকার পরও উদ্দেশ্যমূলক গ্রেফতার করে দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।

আরও পড়ুন: নাম বদলেও ‘স্বস্তি’ দেখছেন না আইনজ্ঞরা

গত ১৮ জুন আদালতে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান ওসি মো. মনিরুজ্জামান ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মিজানুর রহমান। কিন্তু আদালত আবেদন গ্রহণ না করে ২৩ জুলাই আবার তাদের আসতে বলেন। ওই দিন তারা আদালতে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান।

গত ২০ মে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘জামিন নেয়া শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন ২১ মে আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা। তার পরিপ্রেক্ষিতেই ওসিসহ এএসআইকে তলব করা হয়।

গত জুলাই মাসের শেষ দিকে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যাওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২৪ জন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩৪ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ারা ছিল না। গ্রেফতারের পর তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় পুলিশ। এতে অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের।

আরও পড়ুন: ‘মাই লর্ড’ সম্বোধনে বারণ, উৎফুল্ল আইনজীবীরা

রাজধানীর লালবাগ থেকে তুলে নেওয়া ছাত্রদলের ছয় নেতাসহ বিএনপির মোট ১৮ জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদের ছেলে তানভীর আহমেদ (রবিন)-সহ ১২ জনকে নাইটিঙ্গেল মোড় ও বিএনপি কার্যালয়ের আশপাশের এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

পরে ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেফতার ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান ছয় নেতার কাছ থেকে তিনটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তারা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে অস্ত্র সংগ্রহ করছিলেন।

কী বলছেন আইনজীবীরা

উচ্চ আদালতের অনুশাসন উপেক্ষা করে এ ধরনের গ্রেফতারকে আদালত অবমাননা হিসেবে দেখছেন আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত আব্দুল কাইয়ুম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আদালতের আদেশ অমান্য করে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করলে সেটি স্পষ্ট আদালত অবমাননা। আইনের চরম লঙ্ঘন। কারও বিরুদ্ধে পরোয়ানা না থাকলে তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার নিয়ে সিআরপিসির ৫৪ ধারায় বলা আছে। নয়টি কারণে সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করা যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে আপিল বিভাগের স্পষ্ট বিধান আছে, সেগুলো ফলো করা জরুরি।’ 

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু নিয়ে হুঁশ ফেরেনি উচ্চ আদালতের আদেশেও

মামলার শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন- ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালো কাজ করছে। দু’একজন সদস্যের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো বাহিনীকে দায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর দু’একজন সদস্যের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দুর্নামের ভাগিদার হতে হয় সরকারকে।’ 

মানবাধিকার ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আলোচিত আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আগে হাইকোর্টের কথা শুনলে পুলিশ অনেক সম্মান করত। এখন সম্মান করে না। কারণ পুলিশ কারও না কারও ইন্ধন পেয়ে এরকম কাজ করছে। বিরোধী দলের কাউকে গ্রেফতার করলে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই ধন্যবাদ পায় সরকারি দলের কাছ থেকে। এজন্য পুলিশ এরকম কাজ করছে। এটা মোটেও উচিত নয়। আমরা যদি সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টকে সম্মান না করি তাহলে কারও সম্মান থাকে না। আইনের শাসন তো দূরের কথা।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম সুমন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার আতঙ্কে বিরোধী মতকে দমন করতে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করাচ্ছে। সম্প্রতি ছাত্রদলের ছয় নেতাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো মামলার অভিযোগ ছিল না। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এভাবে চলতে থাকলে আইনের শাসন ব্যাহত হবে।’

এআইএম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর