শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘ভঙ্গুর অর্থনীতিতে গতি ফিরেছে, তবে আত্মতুষ্টির জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি’

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

Masrur
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. এম মাসরুর রিয়াজ। ছবি- ঢাকা মেইল

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাসরুর রিয়াজ বলেছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে কৌশলগত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বিগত সময়ে সীমাহীন লুটপাট, দুর্নীতির ফলে ভঙ্গুর হওয়া অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও আমরা আত্মতুষ্টির জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। 

বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সামগ্রিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে হবে। প্রবাসী আয় বাড়াতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে৷ পাশাপাশি দুর্নীতি রোধ করে সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। 


বিজ্ঞাপন


আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মকর্তা ছিলেন ড. এম মাসরুর রিয়াজ। বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তার। বর্তমানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে পিএইচডি করা এই অর্থনীতিবিদ সম্প্রতি একান্ত আলাপচারিতায় দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মুখোমুখি হন ঢাকা মেইলের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাব্বানি

ঢাকা মেইল: অভ্যন্তরীণ রিজার্ভ প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে, শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে করণীয় কী?

এম মাসরুর রিয়াজ: ২০২২ সাল থেকে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক হারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল দেশের আর্থিক খাত। তার একটা বড় কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রার কিছু কৌশলগত অব্যবস্থাপনা। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। তাদের ভালো কিছু পদক্ষেপে এটা একটা স্থিতিশীল জায়গায় এসেছে। স্থিতিশীল বলতে আমি বোঝাচ্ছি ফরেন রিজার্ভ নামতে নামতে ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। সেই জায়গাটায় পতন রোধ হয়ে এটা ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে এসেছে। এছাড়া ডলারের দামও ২২১/২২ টাকা। ফলে বলা যায়, মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। আমি মনে করি, এটা একটা প্রাথমিক স্বস্তির জায়গা৷ কারণ টাকার মান ও রিজার্ভের পতন রোধ করা গেছে। তাই বলে এখানে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমরা পতন রোধ করে রিজার্ভ কিছুটা বাড়িয়েছি। একচেঞ্জ রেট স্টেবল আছে, কিন্তু আমরা রিজার্ভের দিক থেকে শক্তিশালী জায়গায় এখনো যেতে পারিনি। এছাড়া একচেঞ্জিং রেটেও একটা ঝুঁকি রয়ে গেছে। সুতরাং রিজার্ভ বাড়ানোর ওপর আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। 


বিজ্ঞাপন


রিজার্ভ বাড়াতে হলে প্রথমত অন্তত আগামী তিন বছরে অতি প্রয়োজনীয় আমদানি পণ্যের খরচ নিরূপণ করতে হবে। প্রবাসী আয় ও আমদানি-রফতানির একটা সঠিক এসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করতে হবে। আর সেই এসেসমেন্ট অনুযায়ী যেন আমাদনি হয়, তবে যেন এর সীমা ছাড়িয়ে না যায়। 

দ্বিতীয়ত, বিগত সময়গুলোতে অর্থপাচার নিয়ে বড় প্রশ্ন ছিল। সেসময় ব্যাংক লুটসহ নানা প্রকল্পের অর্থ ব্যবসার নামে পাচার হয়েছে। সুতরাং টাকা পাচারের সূত্র ও এর চাহিদা যেন কম থাকে, সেই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তবে কিছুটা সুশাসন আসছে। এটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। অর্থ পাচার হলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কম আসে। যখন আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হয় তখন রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়ে। ফলে হুন্ডির চাহিদা বেড়ে যায়। তাহলে কথা হলো, টাকা পাচার সম্পূর্ণভাবে রোধ করতে হবে। এখানে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। 

তৃতীয়ত, রফতানি সরবরাহ যেন বাড়ে সেই জায়গায় জোরালো নজর দিতে হবে। রফতানির বড় দুটি সূত্র হলো পণ্য সরবরাহ ও রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের আয় বাড়াতে আমাদের জোরালো কোনো কৌশল নেই। দীর্ঘ মেয়াদে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা ও বাড়াতে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। কোন দেশে কেমন চাহিদা, কী ধরনের যোগ্যতার কর্মী প্রযোজন, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। এছাড়া আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি মোটামুটি ভালো আছে। তবে আমাদের কয়েকটি ঝুঁকি আছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে সে বিষয়ে সরকার ও বেসরকারি খাতের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এলডিসির সঠিক সময় নির্ধারণ করা দরকার। আর যদি ২০২৬ সালের নভেম্বরেই এলডিসির সঠিক সময় ধরা হয় তাহলে সে সময়ের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।  প্রয়োজনীয় রসদ, পণ্যের গুণগত মান, দক্ষতা বাড়াতে হবে যেন আমরা রফতানিতে প্রবাহ ধরে রাখতে পারি। আগামীর মার্কেটগুলোতে বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে।

পরিবেশ, সামজিক বিষয়গুলো ও সুশাসনে বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসছে, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ। সেগুলোর সঙ্গে সামাঞ্জস্যাতা রাখার মতো সক্ষমতা এই মুহূর্তে আমাদের নেই। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি কার্যকারিতা, কার্বন নিঃসরণ কমানো এই সক্ষমতাগুলো আনতে হবে। সেজন্য প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারের পলিসি দিয়েও সেগুলোকে সহায়তা করতে হবে। এছাড়া আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ লাগবে। যদিও এটি ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অবস্থা। তবে এটি আমাদের লাগবে। আমাদের উন্নয়ন বাজেট পুরোটা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা যাচাই-বাছাই ছাড়া যাচ্ছে-তাই লোন নিতে পারি না। এটি একমাত্র সমাধান নয়। সুতরাং এই লোনটা খুব ঠান্ডা মাথায়, খুবই বিচার বিশ্লেষণ করে তথ্যপত্রের ভিত্তিতে যেখানে সহজ শর্ত, যেখানে ঋণ না নিলেই নয় সেখান থেকে আমাদের ঋণ সাপ্লাই বাড়াতে হবে। 

মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আনতে পারি। গত অর্থবছরে প্রায় তিন বিলিয়ন এসেছে। অবশ্য তার অর্ধেকই রিইনভেস্টমেন্ট। অর্থ যারা আছে তারাই পুনরায় বিনিয়োগ করেছে। এখান থেকে আমরা স্বল্প সময়ে বড় কিছু আশা করতে পারি না। তবে এখন থেকেই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী এফডিআই আনার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এটিও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বড় একটি সোর্স। ভারত, ভিয়েতনাম প্রতি বছর ১৫ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার পায়। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ২৭ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার এফডিআই পায়। বৈদেশিক রিজার্ভের জন্য এটি একটি বড় শক্তি। 

Masrur2
ড. এম মাসরুর রিয়াজের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ঢাকা মেইল প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাব্বানী। ছবি- ঢাকা মেইল

ঢাকা মেইল: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক ধারায় ফেরাতে কী করা দরকার?

এম মাসরুর রিয়াজ: অর্থনৈতিক ধারা স্বাভাবিক রাখতে মূল্যস্ফীতির হার টেনে ধরত হবে। তবে এটা জন্য মানুষের কষ্ট হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে গেছে। বাজার সরবরাহ বাড়াতে হবে। আমাদের আমদানি শিথিলতা আগের থেকে বেড়েছে। এটিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া অকারণে টাকা ছাপানো বন্ধ করতে হবে। আমাদের কর্মসংস্থান পড়ে গেছে, এটি বাড়াতে হবে। টেকসই কর্মসংস্থান বাড়ে মূলত বিনিয়োগের মাধ্যমে। সেই বিনিয়োগও ভালো অবস্থানে নেই। দেশি বিদেশি দুই রকমের বিনিয়োগই এখন কম। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে। তারা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ চায়। তারা চায় নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা। যেন তাদের বিনিয়োগে নীতিগত পরিবর্তন ও ঝুঁকি কম থাকে। দ্রুত নির্বাচন না হলে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না। পাশাপাশি বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া আমরা আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নও সম্পূর্ণভাবে এগিয়ে নিতে পারবো না। 

কর্মসংস্থানের আরেকটা জায়গা হলে ক্ষুদ্র ব্যবসা। এসব ব্যবসাকে চাঙা করার কিছু কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র ব্যবসাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সীমাহীন লুটপাট, সুশাসনের অভাব, কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগও নিয়েছে। নতুন ব্যাংকে চলার মতো টাকা দেওয়া, গ্রাহককে টাকা ফেরত দেওয়া, এসবের সংকুলান কীভাবে দেওয়া যাবে, ট্যাক্স যতটা কম ধরা যায় তত ভালো। সুতরাং এসব ব্যাংকে একটা যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া।

ঢাকা মেইল: অর্থনৈতিক খাতের চলমান সংস্কার কীভাবে সার্থক করা যায়?

এম মাসরুর রিয়াজ: প্রথম কথা হচ্ছে অর্থনৈতিক সংস্কারের চিত্রটা ভালো নয়। আসলে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাছে আমাদের আশা অনেক বেশি ছিল। কারণ অর্থনৈতিক মন্দা, সুশাসনের অভাব এমন অবস্থায় এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তারা নন-পলিটিক্যাল সরকার। তাদের ভোটের চিন্তা করতে হবে না, তাদের সাহসের সঙ্গে কাজ করার কথা৷ সেই জায়গায় সংস্কার কাজ সহজ হওয়ার কথা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সুশাসনের জন্য ব্যাংকিং খাত, সরকারি প্রকল্প ও জ্বালানি খাতে বেশ কিছু কাজ করেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কেন জানি সেই জায়গায় তারা ম্রিয়মাণ। আমরা অর্থনৈতিক সংস্কারে কোনো কর্মসূচি দেখতেপাইনি। শুধু রিপোর্ট দেখেছি। 

ঢাকা মেইল: বাংলাদেশ-পাকিস্তান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কতটুকু আশাবাদী?

এম মাসরুর রিয়াজ: আমি মনে করি এটা একটা ভালো উদ্যোগ। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আমাদের যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে প্রকৃতপক্ষে সে হিসেবে আমাদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অনেক কম। দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে গত ১৫ বছর অনেক কিছু স্থবির হয়ে পড়েছিল। সুতরাং তাদের সঙ্গে আমাদের আমদানি রফতানিতে যেসব সুযোগ আছে সেগুলো কাজে লাগতে হবে। এছাড়া আমরা আমাদের পর্যটন সম্ভাবনাকেও কাজে লাগাতে পারি। 

ঢাকা মেইল: ভারতীয় পণ্যে মার্কিন শুল্ক বাড়ায় দেশের ব্যবসায়ীরা আশাবাদী হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু? 

এম মাসরুর রিয়াজ: ভারতে যে শুল্কটা বেড়েছে এতে লাভ হবে আমাদের তৈরি পোশাক খাত। তবে ভারতে সবচেয়ে বড় রফতানি খাত সেবা খাতের (আইটি ও প্রযুক্তি) শুল্ক বাড়েনি। তৈরি পোশাক খাতেই আমাদের সম্ভাবনা বেড়ে গেল। তাদের অনেক অর্ডার ইতেমধ্যে আমাদের এখানে এসেছে। শুধু বায়াররা নয় ভারতের অনেক ফ্যাক্টরিও বাংলাদেশে শিফট করতে পারে। অতিরিক্ত চাপ সমাল দেওয়ার জন্য আমাদেরও তৈরি হতে হবে। 

ঢাকা মেইল: আপনাকে ধন্যবাদ।  

এম মাসরুর রিয়াজ: আপনাকেও ধন্যবাদ। 

এমআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর