# দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা
# শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার হচ্ছে
# পারস্পরিক স্বার্থে দুই দেশের মাঝে ৫-৬টি হতে পারে
# দূরত্বের ব্যবধান কমানো গেলে উভয় দেশের জন্য লাভ
দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন ও শীতল সম্পর্ক কাটিয়ে অবশেষে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক উষ্ণতার নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ বাড়ছে, যা দুই দেশের অর্থনীতি ও কূটনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে পাকিস্তানের বাণিজ্য উপদেষ্টা চার দিনের সফরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। সফরের অংশ হিসেবে তিনি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়িক সংগঠনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকায় এসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগের সুযোগ, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের ঢাকা সফরকে ঘিরে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের সম্ভাবনা ও সংকটের জায়গাগুলো আলোচনায় উঠে এসেছে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যা, নির্যাতনের ৫ দশক পেরিয়ে গেলেও দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হয়ে আসে। বরং সব দিক থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়তে থাকে।
বিজ্ঞাপন

তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। এছাড়া সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশ বিকল্প সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ফলে বাংলাদেশ–পাকিস্তান বাণিজ্য দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা ও ভারসাম্যহীনতার মধ্যে আটকে থাকলেও সম্প্রতি প্রেক্ষাপটে আলোচনায় নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এখনো সীমিত পর্যায়ে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, পাটজাত পণ্য পাকিস্তানের বাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা থাকলেও নানা শুল্ক জটিলতা ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
অন্যদিকে পাকিস্তানের তুলা, সুতা, চামড়া ও কৃষিপণ্যের জন্য বাংলাদেশের একটি বড় বাজার হতে পারে। এই সফরে শুল্ক ছাড় ও ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতা দূর করার বিষয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা ফলপ্রসূ আলোচনা করছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে হলে ব্যাংকিং চ্যানেল সহজ করতে হবে এবং দ্বিপাক্ষিক ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (FTA) নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করা জরুরি। এ ছাড়া উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের সরাসরি যোগাযোগ ও বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে রফতানি ও আমদানি দুটোই বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
>> আরও পড়তে পারেন
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির চিন্তা কতটা কাজে দেবে?
পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের সংগঠন পাকিস্তান বিজনেস কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে যেসব পণ্য রফতানি হয় তার একটি বড় অংশই হলো সুতা। এছাড়া লবণ, সালফার, বিভিন্ন রকম পাথর ও সিমেন্ট, সবজি ও ফল, চামড়া, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক দ্রব্য, রং জাতীয় পণ্য আসে।
আর বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য পাকিস্তানে যায় তার মধ্যে রয়েছে পাট ও টেক্সটাইল পণ্য, কাগজ, মেডিক্যাল পণ্য।
কূটনৈতিক উষ্ণতার ইঙ্গিত
শুধু বাণিজ্য নয়, কূটনীতিতেও ইতিবাচক অগ্রগতির ইঙ্গিত মিলছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিগগিরই ঢাকা সফরে আসবেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন ইস্যু যেমন ভিসা সহজিকরণ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
গত কয়েক দশকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশ অতীতের জটিলতা কাটিয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থে সহযোগিতার পথে হাঁটছে।
>> আরও পড়তে পারেন
দেশের ব্যবসায়ী মহলের মতে, পাকিস্তানের সঙ্গে কার্যকর বাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, পাটজাত পণ্য ও হালকা প্রকৌশল সামগ্রী পাকিস্তানের বিশাল বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। অন্যদিকে পাকিস্তানের তুলা, সুতা, চামড়াজাত পণ্য, কৃষি উপকরণ ও ফলমূলের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে সম্ভাবনাময় আমদানিকারক দেশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর দুই দেশের মধ্যে অতীতের ঐতিহাসিক জটিলতা কাটিয়ে একটি নতুন কূটনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলোর প্রতিযোগিতার যুগে বাংলাদেশের জন্য নতুন বাজার তৈরি করা জরুরি। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হলে দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় হবে এবং দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
একই সঙ্গে, চীন-ভারত-পাকিস্তান ভূরাজনীতির সমীকরণে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি নতুন মাত্রা পাবে।
>> আরও পড়তে পারেন
ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী, কী কী চুক্তি হতে পারে?
পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের সাম্প্রতিক অগ্রগতি দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ ও ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিলে উভয় দেশের জন্যই লাভজনক এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে পারে।
যেসব বিষয় চুক্তি হতে পারে
সফরের দ্বিতীয় দিনে ইসহাক দার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। দুই ঘণ্টার এই বৈঠক শেষে পাঁচটি থেকে ছয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা বিলোপ চুক্তি।
২. দুই দেশের বাণিজ্য বিষয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন।
৩. সংস্কৃতি বিনিময় এবং ফরেন সার্ভিস একাডেমিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা।
৪. দুই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা।
৫. বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (BIISS) এবং পাকিস্তানের ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IPRI)-এর মধ্যে সহযোগিতা।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি প্রধান কেন্দ্র হতে পারে যদি পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে।
ব্যবসায়ী সংগঠন জানিয়েছে, সরাসরি ব্যাংকিং চ্যানেল ও শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিলে আগামী দুই বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য দ্বিগুণ হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নে যে দ্বার উন্মোচন হয়েছে এটি ইতিবাচক। ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বেড়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ওনারা (পাকিস্তানের বাণিজ্য ও উপপ্রধান মন্ত্রী) আসছেন।
>> আরও পড়তে পারেন
চলতি বছরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ফ্লাইট শুরু: পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী
‘যদি দুই দেশের মাঝে সম্পর্কোন্নয়ন করা যায় তাহলে দুই দেশের জন্যেই ভালো। আমাদের তৈরি পোশাক, ঔষধ বা পাটজাত পণ্য রফতানি করতে পারবো। পাশাপাশি আমরা তুলা, সুতা, চামড়াজাত পণ্য যদি কম দামে পাই আমদানি করতে পারবো। আলোচনা হতে হবে এমন যেন উভয় দেশ আমরা লাভবান হই।’
এই অর্থনীতিবিদ ঢাকা মেইলকে আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যকার যে আলোচনাগুলো হচ্ছে তাতে আমাদের রফতানি ক্ষেত্রে কি কি অসুবিধা সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা কীভাবে দূর করা যায়- তা নিয়ে কথা বলা দরকার। এছাড়া আইটি ও প্রযুক্তি খাতে পাকিস্তানের বিনিয়োগ নেওয়া যায় কি-না সেবিষয়ে আলোচনা করা দরকার। তাছাড়া পণ্য পরিবহন ও বন্দর ব্যবহারের বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসা দরকার বলে মনে করি।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত হলে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ভিত্তিক একটি শক্তিশালী ইকোনমিক জোন তৈরি হবে বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ।
এদিকে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যেখানে রফতানি ও আমদানির স্বার্থই অগ্রাধিকার পাবে সেটিই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের একমুখী সম্পর্ক গড়া উচিত নয়। প্রতিটি সহযোগীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সীমারেখায়।
তিনি আরও বলছেন, দুই দেশের মধ্যে যেহেতু সরাসরি বন্দর সংযোগ নেই, সব পণ্য তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আসে। এতে ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি সময়ও বেশি লাগে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জায়গা যে খুব বড় সেটা বলা যাবে না।
এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, পাকিস্তান থেকে আমরা বেশি আমদানি করি, আর কম রফতানি করি। এই ব্যবধান যদি কমানো যায়, সেটি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে এবং এটি উভয় দেশের জন্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে লাভজনক এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।
এমআর/এএস

