বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ওড়িশায় ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ওড়িশায় ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা

ভারতের ওড়িশা রাজ্যে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের এক মুসলমান নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার দুই সহকর্মীও পিটুনির শিকার হয়ে এখন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এ ঘটনায় ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে  
পুলিশ।  

গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ওড়িশার সম্বলপুর জেলার আইন্থাপল্লী থানার অন্তর্গত দানিপালি এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
 
সম্বলপুর জেলা পুলিশ জানিয়েছে, নিহত যুবক- ১৯ বছর বয়সী জুয়েল রানা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সুতি অঞ্চলের বাসিন্দা। মাত্র পাঁচদিন আগে তিনি বাড়ি থেকে কাজ করতে ওড়িশা গিয়েছিলেন।


বিজ্ঞাপন


তার দুই সহকর্মী, যারা খুব কাছেই ছিলেন- তারা জানিয়েছেন, দুষ্কৃতকারীরা প্রথমে তাদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে এবং পরিচয়পত্র দেখতে চায়। পরে তাদের বেধরক মারধর শুরু করে।  

পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি সংগঠন বলছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ‘বাংলাদেশি’ এবং ‘রোহিঙ্গা’ ধরার যে বিশেষ প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাভাষী মুসলমানরা এভাবে একের পর এক বাংলাদেশি সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন।

কী ঘটেছিল বুধবার রাতে?

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পরিযায়ী নির্মাণ শ্রমিক পল্টু শেখ বলেন,

তিনি আরও জানান, এর আগেও বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে তাদের হুমকি দিয়েছে স্থানীয় লোকেরা। কিন্তু এতদিন কেউ মারধর করেনি, যে ঘটনা ঘটল বুধবার রাতে।

তার কথায়, ‘ওদের হাত থেকে একজন পালিয়ে এসে আমাদের ঘরে খবর দেয় যে আমায় বাঁচাও, মেরে ফেলছে। আমরা সবাই তখন বেরিয়ে আসি।’

আরেকজন নির্মাণ শ্রমিক সাদ্দাম হুসেন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘চিৎকার শুনে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি ওই লোকগুলো অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গেল। এরপর আমরা সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। জুয়েল মারা গেছে। গ্রামে খবর দেওয়া হয়েছে।’

মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি এক নম্বর ব্লকের অধীন চক বাহাদুরপুর গ্রামে জুয়েল রানার বাড়ি।

তার এক কাকা রিয়াকুল শেখ বিবিসিকে বলেন, তিনি প্রত্যক্ষদর্শী অন্যান্য শ্রমিকদের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, ‘ওরা তিনজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিড়ি খাওয়ার সময়েই এই ঘটনা। চার-পাঁচ জন গুন্ডা এসেছিল। তারা জুয়েলদের তিনজনকে বলে যে তোমরা বাংলাদেশি, ভারতে কেন থাকবে। জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে বলেছিল। মারধর করার সময়ে মোবাইল কেড়ে নেয়।’

ওড়িশা পুলিশ কী বলছে

যে এলাকায় জুয়েল রানাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেই আইন্থাপল্লী থানা এলাকাটি সম্বলপুর মহকুমার অধীন।

মহকুমা পুলিশ অফিসার তোফান বাগ ঘটনাক্রমের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী জুয়েল রানার সহকর্মীদের বয়ান প্রায় মিলে গেছে।

তিনি বলেছেন, ‘তিনজন শ্রমিক বিড়ি খাচ্ছিলেন। সেই সময়ে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা সেখানে গিয়ে আধার কার্ড দেখতে চায়। তারপরেই তিনজনকে মারধর করে। একজন ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। তার মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে এবং পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছয়জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং তদন্ত এখনো চলছে।

অন্যদিকে দুজন আহতকে সম্বলপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং তাদের শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল বলে জানা গেছে।

কেন একের পর এক গণপিটুনিতে মৃত্যু?

ডিসেম্বর মাসেই ভারতের তিনটি রাজ্যে গণপিটুনিতে মৃত্যুর তিনটি ঘটনা সামনে এসেছে। এর মধ্যে বিহারে একজন মুসলমান ফেরিওয়ালা তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে গণপিটুনির শিকার হয়ে হাসপাতালে মারা যান। তিনি পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে ছত্তিশগড় থেকে কেরালায় কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন। এছাড়াও কেরালায় একজন দলিত শ্রেণির হিন্দুকে বাংলাদেশি সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়।

তৃতীয় ঘটনাটি বুধবার রাতে, ওড়িশা রাজ্যে ঘটল। জুয়েল রানাও পরিযায়ী শ্রমিক ছিলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে কাজে গিয়েছিলেন ওড়িশায়।

ওড়িশা রাজ্যে এ মাসেই বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা এক মুসলমান যুবক। তাকে মারধর ও ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী এই রাজ্যটিতে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো ঘটনা সামনে এসেছে যেখানে বাংলাভাষী শ্রমিক, ফেরিওয়ালাদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে গণপিটুনি বা হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।

পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক বলছিলেন, 

তিনি অভিযোগ করেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার সাত-আট মাস আগে যে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা খুঁজে বার করে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করার নির্দেশ দিয়েছে, তার ফলেই এধরনের ঘটনা খুব বেড়ে গেছে। ওই নির্দেশ ছিল সব রাজ্যের পুলিশের প্রতি, কিন্তু সেই সুযোগটা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এই কাজে নেমে পড়েছে। আর ওড়িশায় বিজেপি-ই তো এখন ক্ষমতায়। তাই বোঝাই যাচ্ছে যে কাদের প্রচ্ছন্ন মদতে এই গণপিটুনি আর হেনস্থার ঘটনা ঘটছে।’ 

তার দাবি, রাজ্য প্রশাসন ওড়িশা সরকারের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করুক।

নিহত জুয়েল রানার বাড়ি যে অঞ্চলে, তার পাশের বিধানসভা কেন্দ্রে বিধায়ক ও রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের প্রতিমন্ত্রী আখতারুজ্জামান বলছিলেন, ‘রাজ্যের মুখ্যসচিব তার পর্যায়ে কথা বলেছেন, আমাদের সরকার বারবার কেন্দ্রীয় সরকারকেও জানিয়েছে বিষয়টা। কিন্তু বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার বা যে-সব রাজ্যে বিজেপি সরকার আছে, তাদের মূল অ্যাজেন্ডাই তো বাঙালি বিরোধী, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান বিরোধী’।বিবিসি বাংলা


এমএইচআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর