শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভারতে মুসলিম যুবককে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে মারধর, বলানো হয় ‘জয় শ্রীরাম’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

ভারতে মুসলিম যুবককে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে মারধর, বলানো হয় ‘জয় শ্রীরাম’

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশায় এক মুসলিম যুবককে মারধর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাহুল ইসলাম নামের ওই যুবক পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরপাড়া থানা এলাকার বাসিন্দা।

অভিযোগ রয়েছে, ওড়িশার গঞ্জাম জেলার একটি গ্রামে কিছু হিন্দুত্ববাদী রাহুল ইসলামকে তার পরিচয়পত্র যাচাই করেন এবং তা দেখানোর পরে তারা সেগুলি ভুয়া বলে অভিহিত করে এবং তিনি একজন ‘বাংলাদেশি’ এবং ‘রোহিঙ্গা’ – এই কথাও বলা হয়। এরপরেই তাকে মারধর করে 'জয় শ্রীরাম' এবং 'ভারতমাতা কি জয়' বলানো হয়।


বিজ্ঞাপন


‘জয় শ্রীরাম’ নির্দিষ্টভাবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির স্লোগান। ‘ভারতমাতা কি জয়’ স্লোগানটিকে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মনে করে যে সেটি ভারত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ। বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানরা দেশের প্রতি অনুগত কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য এই স্লোগানটি অনেক সময়েই ব্যবহার করে থাকে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন।

ঘটনাটি জানিয়ে ওড়িশা পুলিশ, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে ই-মেইল করেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি সংগঠন।

গতবছরের মাঝামাঝি সময়ে ওড়িশায় ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকার এ বছরের মার্চ মাসে রাজ্য বিধানসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল, রাজ্যটিতে ৩ ৭৪০ জন বাংলাদেশিকে খুঁজে পেয়েছে, যারা বৈধ নথি ছাড়া বসবাস করছিলেন। গতবছরের মাঝামাঝি সময়ে ওড়িশায় ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি।

এর আগে ভারতের নানা রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিচয় যাচাইয়ের নাম করে যেভাবে আটক রাখা হচ্ছিল, এবার ওড়িশা রাজ্যেও তা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের সংগঠনগুলি।


বিজ্ঞাপন


তারা বলছে, গত ১০ দিনে অন্তত ৩০০ জন পরিযায়ী শ্রমিক এবং ফেরিওয়ালাকে আটক করে রাখা হয়েছিল। কাউকে তিনদিন, কাউকে পাঁচদিন পর্যন্ত আটক রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ।

ওড়িশা থেকে বিবিসির সংবাদদাতা সুব্রত পতি জানাচ্ছেন যে 'অবৈধভাবে কোনও বাংলাদেশি' ওড়িশায় থাকছেন কিনা, তা খুঁজতে জেলা স্তরে এ ধরনের পুলিশি অভিযান চলছে। পরিচয়পত্র যাচাই করার পরে ভারতীয় বলে নিশ্চিত হওয়ার পরে ছেড়েও দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিক অভিযোগ করেছেন, তাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওড়িশা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। এরকমই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে মঙ্গলবার নিজের এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র। ওই ঘটনায় ওড়িশা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করারও হুমকি দিয়েছেন তিনি।

রাহুল ইসলামকে যেভাবে 'জয় শ্রীরাম' বলানো হল

২৪ বছর বয়সি রাহুল ইসলাম সেদিন গিয়েছিলেন ওড়িশার গঞ্জাম জেলার রানীপাড়া গ্রামে। ওড়িশায় তিনি বিছানার চাদর, শীতের পোশাক – এসব ফেরি করেন। এসময় হঠাৎই তার কাছে একজন স্থানীয় গ্রামবাসী পরিচয় জানতে চান। 

রাহুলের সঙ্গীরা অভিযোগ করছেন, তিনি ওই গ্রামবাসীকে আধার কার্ড দেখালে সেটি ফেলে দেওয়া হয়। তাকে বলা হয়, সেটি নকল, রাহুল ইসলাম আসলে ‘বাংলাদেশি’, ‘রোহিঙ্গা’। 

ইসলামের সঙ্গে একই ঘরে ভাড়া থাকা মাইনুল সরকার বলেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও প্রায় ২৫-৩০ জন জড়ো হয়ে যায়। সবাই মিলে ঘিরে ধরে ওকে (রাহুল) মারতে থাকে। কেউ চড়-থাপ্পড় মারে, তো কেউ লাথি মারে। কয়েকজন লাঠি দিয়েও ওকে মারছিল। ভারতমাতা কি জয় আর জয় শ্রীরাম বলেছিল রাহুল, তবুও মার বন্ধ হয়নি।’ ।

image
মার খাওয়ার পরে ‘জয় শ্রীরাম’ ও ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলেন রাহুল ইসলাম

তিনিও মুর্শিদাবাদে রাহুল ইসলামের গ্রাম চক হরেকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা এবং একই সঙ্গে ওড়িশায় শীতবস্ত্র ফেরি করেন।

ওই ঘটনার কিছু অংশের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাহুলকে মারধর করার সঙ্গেই ‘জয় শ্রীরাম’ এবং ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলতে বলা হচ্ছে। রাহুল ইসলাম সেটা বলছেনও, তবুও মারধর আর লাথি মারা থামছে না।

মাইনুল বলছিলেন, ‘পরের দিন সকালে আমরা স্থানীয় থানায় গিয়েছিলাম অভিযোগ জানাতে। কিন্তু পুলিশ আমাদের বলে যে তারা এই অভিযোগ নিতে পারবে না।’ তবে কোদালা থানার ওসি সুবাস বেহেরা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তার কাছে ওই ঘটনার কোনও খবর নেই।

মাইনুল আরও বলেন, ‘রাহুলকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন, ইনজেকশনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওর সারা গায়ে এখনও কালশিটে আছে, শরীরে খুব ব্যথা। পেটে লাঠি দিয়ে মেরেছিল, সেই ক্ষতটা রয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমরা যে চারজন একসঙ্গে থাকতাম, সবাই মুর্শিদাবাদে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছি।’

পরিচয় যাচাইয়ের নামে আটক

ওড়িশার কেন্দ্রপাড়া জেলায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন টুটুল চৌধুরী। তাকে সহ মোট ১৬ জনকে ১৭ই নভেম্বর পাঁচদিন আটক রাখার পরে ছেড়েছে পুলিশ।

এ বিষয়ে টুটুল বলছিলেন, ‘সেদিন রাত ১০টা নাগাদ আমাদের ঘরে পুলিশ আসে। তারা বলে যে, আমরা যেন আধার কার্ড নিয়ে থানায় দেখা করতে যাই ওই রাতেই। আমরা সেখানে যাওয়ার পরে পুলিশ বলে তোমাদের ছাড়া যাবে না, আটক থাকতে হবে। থানা থেকে আমাদের পলিটেকনিক কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে খাবার দিত ঠিকই, কিন্তু বেরোতে পারতাম না আমরা। মাঝে মাঝেই এসে আমাদের পরিচয় জানতে চাইত, বাবার নাম, গ্রামের নাম – এসব বারবার জিজ্ঞাসা করত। আজ ছাড়বে কাল ছাড়বে এই করে পাঁচদিন আমাদের আটক থাকতে হল। এর মধ্যে কোনও আদালতে তোলা হয়নি আমাদের।’ 

কেন্দ্রপাড়া জেলার পুলিশ সুপার সিদ্ধার্থ কাটারিয়া বলেছেন, ‘এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সন্দেহভাজনদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য ডাকছি। জুন মাসে আমরা ৫০ জনেরও বেশি মানুষের পরিচয় যাচাই করেছি। কয়েকদিন আগে ১৬ জনকে ডাকা হয়েছিল, এখন আবার চারজনকে ডাকা হয়েছে। তবে কাউকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করা হয়নি।’

ওড়িশার আরেকটি জেলা জগৎসিংপুরের পুলিশ সুপার অঙ্কিত কুমার ভার্মা জানিয়েছেন, তার জেলাতেও কয়েকজন ‘সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে’ আটক করা হয়েছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার ভদ্রক জেলায় এমন নয়জনকে আটক করা হয়েছিল, যাদের কাছে মুর্শিদাবাদ জেলার পরিচয়পত্র আছে। তাদেরও পরিচয় যাচাই করা হচ্ছে বলে ওই সংবাদপত্রটিকে জানিয়েছিল জেলা পুলিশ।

তবে রাজ্য জুড়ে কতজনকে আটক করা হচ্ছে বাংলাদেশি বলে, সেই হিসাব কেন্দ্রীয়ভাবে ওড়িশা পুলিশ দেয়নি।

পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ বলছে যে, তাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তাতে ৩০০ জনেরও বেশি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাকে গত ১০ দিন আটক করা হয়েছিল।

সংগঠনটির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক বলছিলেন, ‘মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে যারা শ্রমিক হিসাবে বা ফেরি করতে যান, এরকম তিনশরও বেশি মানুষকে আটক করার খবর পেয়েছি আমরা। আদালতে পেশ না করে এভাবে আটক করে রাখা তো অসাংবিধানিক।’

তিনি বলেন, ‘অনেক জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিকদের রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি তকমা দেওয়া হচ্ছে, অথচ এরা সকলেই ভারতের নাগরিক। আমরা ওড়িশা পুলিশের কাছে ই-মেইল করে অভিযোগ জানিয়েছি, কোনও উত্তর আসেনি। এরপর আমরা জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশনেও অভিযোগ করেছি।’

অন্য রাজ্যেও পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তা করা হচ্ছে, তবে ওড়িশায় একটা নতুন বিষয় চোখে পড়ছে জানিয়ে আসিফ ফারুক বলেন, ‘এখানে দেখছি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সদস্যরাও পরিযায়ীদের পরিচয় যাচাই করতে শুরু করেছে। তারাই আবার গণপ্রহারে অংশ নিচ্ছে। ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি রোহিঙ্গা তকমা দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই বিপজ্জনক।’ বিবিসি বাংলা 

এমএইচআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর