‘আমাকে স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করেছিল। যখনই আমি বললাম যে তার নাম মুহাম্মদ আতাহার হুসেইন, সঙ্গে সঙ্গেই আট-দশজন মারতে শুরু করল। আমার স্বামীকে মেরে ফেলল। আমি বিধবা হয়ে গেলাম, সন্তানরা অনাথ হয়ে গেল! এখন ওরা কাকে বাবা বলে ডাকবে?’
সেই রাতের ঘটনা সম্পর্কেএ কথাগুলো বলছিলেন মুহাম্মদ আতাহার হুসেইন নামে এক ফেরিওয়ালার স্ত্রী শবনম পারভিন। এইটুকু বলেই কেঁদে ফেললেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
পুলিশের এফআইআর অনুযায়ী, গত ৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারের নাওয়াদা জেলায় রোহ অঞ্চলের ভট্টা গ্রামে ৪০ বছর বয়সি মুহাম্মদ আতাহার হুসেইনকে নৃশংসভাবে মারা হয়েছিল। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে বিহার শরীফ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই চিকিৎসা চলাকালীন গত ১২ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় দুটো এফআইআর হয়েছে। একটি করেছে তার পরিবার, অন্যটি দায়ের করেছে যাদের বিরুদ্ধে তাকে গণপিটুনির অভিযোগ আছে – তাদের পক্ষ থেকে। গণপিটুনির অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
আতাহার হুসেইনের পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে যে চুরির ভুয়া অভিযোগে বেশ কয়েকজন তাকে নৃশংস ভাবে মারধর করে। আর যাদের বিরুদ্ধে তাকে গণপিটুনি দেয়ার অভিযোগ, তারা পাল্টা অভিযোগ করছে যে আতাহার হুসেইন চুরির উদ্দেশে রাত্রে তাদের ঘরে ঢুকেছিলেন এবং চুরি করতে তাকে হাতেনাতে ধরা হয়েছিল।
আতাহার হুসেইনকে গণপিটুনি দেওয়া এবং তার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে।
বিজ্ঞাপন
কী বলছে পুলিশ?
আতাহার হুসেইন বিহারের নালন্দা জেলার বাসিন্দা ছিলেন। বিহার শরীফ এলাকার গগন দিওয়ান গ্রামে তার বাড়ি। তার পরিবার বলছে, তিনি গত প্রায় ২০ বছর ধরে রোহ এবং তার আশপাশের এলাকায় সাইকেলে চেপে কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তার শ্বশুরবাড়িও ওই অঞ্চলেরই মরুই গ্রামে।
নওয়াদা সদর ডেপুটি পুলিশ সুপার (ডিএসপি) হুলাস কুমার বলছেন, ‘৫ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ খবর পায় যে একজন চোরকে চুরি করতে ধরে রেখেছে মানুষ। পরের দিন দুটো এফআইআর হয়। একটিতে আতাহার হুসেইনকে চুরির ঘটনায় মূল অভিযুক্ত করা হয়, আর অন্যটিতে তার স্ত্রী অভিযোগ করেন যে তাকে মারধর করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যে তাকে মারধর করা হয়েছে, এটা বলা হয় নি।’
ডিএসপি কুমার আরও বলছেন, তারা তদন্ত করে আতাহার হুসেইনের কোনও অপরাধমূলক কাজের রেকর্ড খুঁজে পান নি।
অন্যদিকে আতাহারের ভাই মুহাম্মদ চাঁদ বলছেন, ‘৬ ডিসেম্বর আমরা যখন এফআইআর দায়ের করি তখনও তো আমার ভাই অজ্ঞান ছিল। আমাদের কাছে শুধু চুরির ভুয়া অভিযোগে মারধর করারই খবর ছিল। এরপরে যখন ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে আমাদের বলে যে কীভাবে তার কাপড় খুলিয়ে ধর্মীয় পরিচয় জানা হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, তারা দ্বিতীয় এফআইআর দায়ের করবেন।
মুসলমান পুরুষরা গ্রামের বাইরে যাচ্ছেন না
আতাহার হুসেইনের ভাই মুহাম্মদ চাঁদ বলছিলেন, ‘আমরা সবাই ভয়ে আছি। আমাদের গ্রামের কোনও মুসলমান পুরুষ ফেরি করতে বা পশু বা অন্যান্য ব্যাপারীরা গ্রামের বাইরে বেরচ্ছে না।’
তিনি বলছিলেন, মৃত্যুর আগে তার ভাই জানিয়েছিলেন যে ৫ ডিসেম্বর রাতে কাপড় ফেরি করে যখন ডুমরি গ্রাম থেকে নিজের বাড়ির দিকে ফিরছিলেন তখন তার সাইকেলের চাকা পাঙচার হয়ে যায়।
চাঁদের অভিযোগ, ‘অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল তখন। ভট্টা গ্রামের পাশে একটা মোড়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন কয়েকজন মানুষ – তাদের কাছেই ভাই জানতে চায় যে পাঙচার সারানোর দোকান কোথায় আছে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকা ওই ব্যক্তিরা ভাইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করে। যেই নিজের নাম মুহাম্মদ আতাহার হুসেইন বলে ভাই, তখনই হামলা করে ওই ব্যক্তিরা। সেখানে আট-দশজন ছিল। জোর করে সাইকেল থেকে ভাইকে নামিয়ে তার সব টাকা-পয়সা লুঠ করে নেয় আর ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করার পরে হাত-পা বেঁধে টানতে টানতে তাকে একটা ঘরে নিয়ে যায় ওরা। সেখানেই বেধরক মারধর করে আধমড়া করে ফেলে দেয় ওরা।’
তিনি আরও জানান, ওই লোকেরা ভেবেছিল যে তার ভাই মারা গেছে। তারপরেই পুলিশকে ফোন করে চুরির কাহিনিটা সাজায় ওরা।
পুলিশ এসে আতাহার হুসেইনকে নওয়াদা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করায়।
স্ত্রী কীভাবে খবর পেলেন
আতাহার হুসেইনের স্ত্রী শবনম বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা এই ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। পরের দিন সকালে কেউ একজন মি. হুসেইনকে মারধর করার ছবি দেখায়। ওই ছবিটি এলাকার অনেকে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করছিলেন। এভাবেই আতহারের পরিবার ঘটনাটি জানতে পারে।
শবনম বলেন, ‘ছবিটি দেখে আমি তো প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। চিৎকার করে কাঁদছিলাম আমি। দেওর শাকিব আর চাঁদ হাসপাতালে তাদের ভাইকে দেখতে গিয়েছিল। তখনও আমার স্বামী অজ্ঞান ছিলেন। ঘণ্টাখানেক পরে আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছাই, দেখি তাকে ভীষণ মেরেছে। আমার গলার আওয়াজ পেয়েই ওর জ্ঞান ফেরে – ধীরে ধীরে চোখ খোলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, “ভীষণ ব্যথা। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করো। আমার চিকিৎসা করাও”। ওখানে যে পুলিশ ছিল তাদের আমি অনেক বলেছিলাম, তবুও ওরা আমার স্বামীকে নিয়ে যেতে দেয় নি, বলেছিল ওখানেই চিকিৎসা হবে, কোথাও যেতে দেওয়া হবে না।’ ।
পরিবার বলছে, তিন দিন পরে আতহারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। পরিবার অনুরোধ করেছিল কোনও বেসরকারি হাসপাতালে তাকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হোক। পরে পাওয়াপুরী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয় আতহারকে। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না দেখে একদিন পরে পরিবারের সদস্যরা আহত আতাহার হুসেইনকে নিয়ে বিহার শরীফ হাসপতালের দিকে রওনা হন। তবে পথেই মৃত্যু হয় তার। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার দেহের ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসে নি।
চুরির অভিযোগ
আতাহার হুসেইনের স্ত্রী ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ পর্যন্ত পুলিশ ১১ জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। আটকরা সকলেই ভট্টা গ্রামের বাসিন্দা। বাকি অভিযুক্তদেরও দ্রুত গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আতহারের স্ত্রী শবনমের দায়ের করা অভিযোগের পাল্টা আরেকটি মামলাও দায়ের হয়েছে। যে গ্রামে আতহারকে মারধর করা হয়েছিল, সেই ভট্টা গ্রামের বাসিন্দা সিকান্দার যাদব আতাহার হুসেইনের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ দায়ের করেছেন।
পুলিশ অবশ্য আতহারেকে মারধর করার ঘটনায় সিকান্দার যাদবকেও গ্রেফতার করেছে। তার বাড়িরই একটি ঘরে আতহারকে মারধর করা হয়েছিল।
যাদবের স্ত্রী বিন্দি অভিযোগ করছিলেন, আতাহার হুসেইন তাদের ঘরে চুরি করার সময়ে তার চেঁচামেচিতেই লোক জড়ো হয়ে যায় এবং তাকে ধরে ফেলে মারধর করে।
ঘটনার ১৫ দিন কেটে গেলেও বিন্দির ঘরে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যে ঘরটাতে মি. হুসেইনকে মারধর করা হয়েছিল, সেই ঘরটি রাস্তার পাশেই। দেখা গেল কাঁচি, প্লাস, লোহার রড ইত্যাদি পড়ে আছে সেখানে। সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে সরিয়ে ফেলা হল সেগুলো।
বিন্দি দাবি করছিলেন, ‘দুই-তিন লাখ টাকার গয়না চুরি হয়ে গেছে। চোর ধরা পড়ার পরে বাসনপত্র তো পাওয়া গেছে কিন্তু গয়না পাওয়া যায় নি। একজন চোর ধরা পড়েছিল, বাকি চোরেরা হয়ত পালিয়ে গেছে।’
সিকান্দার যাদব আর তার স্ত্রী দিন মজুরের কাজ করেন। বাড়িতে টয়লেটও নেই – মাঠে যেতে হয় বাড়ির নারীদের। এরকম একটি পরিবারের ঘরে দুই-তিন লাখ টাকার গয়না কি আদৌ রাখা থাকতে পারে? প্রশ্ন উঠেছে।
এই গ্রামে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই বসবাস। এক বাসিন্দা মুহাম্মদ আসগার বলছিলেন, ‘আতাহার প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে সাইকেলে চেপে কাপড় ফেরি করেন। নারী ও শিশুদের জামা কাপড় বিক্রি করতেন তিনি। ওর শ্বশুরবাড়িও রোহ এলাকায়, নিয়মিতই আসতেন। গ্রামের নারীরা তো সবাই চিনত আতাহারকে।’বিবিসি বাংলা
এমএইচআর

