বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পাকিস্তানের সাবেক যে প্রধানমন্ত্রীদের ‘নিরাপত্তা হুমকি’ আখ্যা দেওয়া হয়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৫ পিএম

শেয়ার করুন:

পাকিস্তানের সাবেক যে প্রধানমন্ত্রীদের ‘নিরাপত্তা হুমকি’ আখ্যা দেওয়া হয়

পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী সম্প্রতি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ বলে বর্ণনা করেছেন।

গত শুক্রবারের সেই সাংবাদিক সম্মেলনে তাকে ইমরান খানের কড়া সমালোচনা করতে শোনা গিয়েছিল। তার গলার সুর থেকে বর্তমান পরিস্থিতির কিছুটা হলেও ঝলক পাওয়া যায়।


বিজ্ঞাপন


আহমেদ শরীফ চৌধুরীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘ওই ব্যক্তির (ইমরান খানের প্রতি ইঙ্গিত করে) বক্তব্য আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আরও বলেছেন, ‘এই ব্যক্তির (ইমরান খান) মানসিক অসুস্থতার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।’

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সে দেশেরই জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বর্ণনা করা এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সামরিক মুখপাত্রের কঠোর ভাষার বিশেষ অর্থ রয়েছে। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ইতিহাসের কথা মাথায় রাখলে অবশ্য এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, নতুনও নয়। এমন ঘটনা সে দেশের ইতিহাসে আগেও দেখা গিয়েছে।


বিজ্ঞাপন


দেখে নেওয়া যাক, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ বা ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ শব্দ ব্যবহারের ইতিহাস কী, এখনো পর্যন্ত কাকে কাকে এই আখ্যা দেওয়া হয়েছে?

একই সঙ্গে দেখে নেওয়া যাক এই জাতীয় ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ তৎকালীন রাজনীতি, দেশের ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রের জন্য কতটা মারাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছিল? আর যে সমস্ত ব্যক্তিকে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একসময় ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, তারাই কীভাবে পরবর্তীকালে ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে উঠলেন?

‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’

পাকিস্তানের জন্মের পরের গোটা দশকই রাজনীতিবিদ, বেসামরিক নাগরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। যে জন্য সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ ঘটেনি। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর বদল হতে থাকে এবং সরকারের পতন হতে থাকে। শেষপর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পরিস্থিতি ও ঘটনাক্রমকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে বর্ণনা করে ক্ষমতা দখল করেন।

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাও নানাভাবে সীমিত করে দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে, বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্রের শর্তে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করা হয়। শর্ত অনুযায়ী, তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ জনপ্রিয় এই নেতাকে বলা হয়েছিল তিনি যাতে পশ্চিমাপন্থী পররাষ্ট্রনীতি অব্যাহত রাখেন এবং সামরিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করেন।

কাইয়ুম নিজামি তার ‘জেনারেলস অ্যান্ড পলিটিশিয়ানস ইন দ্য কোর্ট অব হিস্ট্রি’ বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিভিল আর্মি অফিসারদের (নাগরিক সেনা কর্মকর্তা) সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। যখন শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সরদার আব্দুর রব নিশতারকে সহায়তা করার জন্য আইয়ুব খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তখন এই বিষয়টাকে তিনি সামনে থেকে প্রত্যক্ষও করেছিলেন।

পরে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন সরদার আব্দুর রব নিশতার। সেই প্রতিবেদনে তিনি (সরদার আব্দুর রব নিশতার) অভিযোগ তুলেছিলেন যে, আইয়ুব খান তার দায়িত্বের প্রতি পেশাদার মনোভাব গ্রহণ করেননি।

এর উত্তরে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘আমি এই সামরিক কর্মকর্তাকে চিনি। তিনি সামরিক বিষয়ের চেয়ে রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী।’

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর তার প্রথম ভাষণের সময় রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে কড়া শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘ঝামেলা সৃষ্টিকারী, রাজনৈতিক সুবিধাবাদী, চোরাকারবারি, ফেরিওয়ালা ও অন্যান্য সামাজিক কীটপতঙ্গ, হাঙ্গর এবং জোঁকদের জন্য কয়েকটা শব্দ রইল- সেনাবাহিনী এবং জনগণ আপনার উপস্থিতিকে ঘৃণা করে। নিজ স্বার্থে আপনার একটা নতুন যুগ শুরু করা এবং পন্থা পরিবর্তন করা উচিত। অন্যথায় প্রতিশোধ নিশ্চিত এবং তা দ্রুত হবে।’

এক্ষেত্রে যেটা তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই আইয়ুব খান এক আইন প্রণয়ন করেছিলেন। তার নাম ছিল ‘ইলেক্টিভ বডিস ডিস্কোয়ালিফিকেশন অর্ডার’।

এই আইনের আওতায় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এই আইন মূলত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তৈরি করা হয়েছিল, যার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল জনগণের চোখে রাজনীতিবিদদের দুর্বল করে দেওয়া।

ফাতিমা জিন্নাহ ও বেনজির ভুট্টো

প্রথম ‘মার্শাল ল’ বা সামরিক আইন জারি হওয়ার পরে, সরকারবিরোধী শিবিরে থাকা রাজনীতিবিদদের বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে বিবেচনা করার বিষয়টা ক্রমে এক ধরনের রীতি হয়ে দাঁড়ায়।

আয়ুব খান ও ফাতিমা জিন্নাহর মধ্যে যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ফাতিমা জিন্নাহকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ পর্যন্ত বলা হয়েছিল। ফাতিমা জিন্নাহর চরিত্রকে আক্রমণ করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দেশ ভাঙার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে সে সম্পর্কে পুস্তিকাও বিলি করেন আইয়ুব খান ও তার সমর্থকরা।

হামিদ খান তার বই ‘পাকিস্তানের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘আইয়ুব খান সরকার ফাতিমা জিন্নাহর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং দেশবিরোধী মনোভাব তৈরি করেছিলেন।’

পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া রচনাকারী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং তার মেয়ে বেনজির ভুট্টোকেও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

কাইয়ুম নিজামি তার বইয়ে লিখেছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান সফর করেছিলেন। রাজীব ও বেনজির দুজনেই তরুণ নেতা ছিলেন। তাদের বিষয়ে সাধারণ ধারণা ছিল যে দুজনেই অতীতের ঘৃণা ভুলে নতুন যুগের সূচনা করবেন।’

image
ফাতিমা জিন্নাহ ও বেনজির ভুট্টো।

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান ও ভারত একে অপরের পরমাণু স্থাপনায় হামলা না করার বিষয়ে একটা চুক্তিতে পৌঁছায়। এরই মাঝে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দুই নেতার বৈঠকের উপর নজর রাখছিল এবং তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে বেনজিরকে বিশ্বাস করা যায় না।’

এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন সমাজকর্মী ও ইতিহাসের শিক্ষক আম্মার আলী জান। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে, কখনো সব বাঙালিকে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, কখনো জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, আর কখনো ফাতিমা জিন্নাহ ও বেনজিরকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে ঘোষণা করা হয়েছে।’

নওয়াজ শরীফ ও ইমরান খান

এই প্রসঙ্গে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে নওয়াজ শরিফের ভাষণও মনে রাখতে হবে। বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে ভিডিও লিঙ্ক মারফত নিজের ভাষণ পেশ করেছিলেন তিনি।

নওয়াজ শরীফ বলেছিলেন, ‘যারা দেশের সংবিধান ভঙ্গ করেছে তারা দেশপ্রেমিক এবং এই বৈঠকে উপস্থিত দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশদ্রোহী।’

 

image
নওয়াজ শরীফ ও ইমরান খান

তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কমার জাভেদ বাজওয়াকে উদ্দেশ্য তিনি বলেন, ‘নওয়াজ শরীফকে আপনি বিশ্বাসঘাতক বলতে চাইলে অবশ্যই বলুন। তবে নওয়াজ শরীফ জনগণকে দিয়ে ভোটকে সম্মান করাবেন।’

অক্টোবরে লাহোরে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়, যার জবাবে মি. শরীফের দল কড়া প্রতিক্রিয়া জানায়।

ঠিক একইভাবে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে, নওয়াজ শরীফ লন্ডন থেকে একটা ভিডিও বার্তা দেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথমে আপনারা করাচির হোটেল রুমের দরজা ভেঙে দেন যেখানে মরিয়ম ছিল আর এখন আপনারা তাকে হুমকি দিচ্ছেন। মরিয়মের যদি কোনোরকম ক্ষতি হয়, তাহলে তার জন্য ইমরান খান, সেনাপ্রধান কমার জাভেদ বাজওয়া এবং ডিজি আইএসআই জেনারেল ফয়েজ হামিদ দায়ী থাকবেন।’

প্রসঙ্গত, এটা সেই সময়ের ঘটনা যখন নওয়াজ শরীফ, তার দল ও ক্ষমতাসীন সামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তেজনার পরিস্থিতি ছিল এবং মনে করা হচ্ছিল সেখান থেকে তাদের ফিরে আসার কোনো উপায় নেই।

এর আগে, ২০১৮ সালের মে মাসে, তৎকালীন শাহিদ খাকান আব্বাসী সংসদে ভাষণ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘দেশকে অপরাজেয় করে তুলেছেন এমন ব্যক্তির সম্পর্কে রাষ্ট্রদ্রোহের কথা বলাটা গ্রহণযোগ্য নয়।’

তৎকালীন শাহিদ খাকান আব্বাসীর ভাষণের প্রেক্ষাপট ছিল নওয়াজ শরীফ এক সাক্ষাৎকার। ইংরেজি দৈনিককে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সামরিক সংগঠনগুলো সক্রিয়। এদেরকে বলা হয় নন-স্টেট অ্যাক্টর। আমরা কি তাদের সীমান্ত পেরিয়ে মুম্বাইয়ে ১৫০ জনকে হত্যা করতে পারি?’

নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে যখন দেশদ্রোহীতার অভিযোগ তোলা হয় তখন তিনি বলেন, ‘আমি যদি দেশদ্রোহী হই, তাহলে জাতীয় কমিশন গঠন করুন।’

এটা লক্ষণীয় যে ২০১৩ সালে নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় আসার সময় থেকে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং তারপরে ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত, ক্ষমতাসীন সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শীর্ষে ছিল।

তাদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব ১৯৯০ থেকেই থেমে থেমে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। শেষে ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বের অবসান হয়।

জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনকালে, নওয়াজ শরীফ এবং তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিমান ছিনতাই করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে মামলা করা হয়েছিল। ঠিক যেমন নওয়াজ শরীফের সঙ্গে ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব হয়েছিল এবং তাকে অভিযোগের সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছিল, বর্তমানে সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন ইমরান খান।

আইএসপিআর-এর ডিরেক্টর জেনারেলের সংবাদ সম্মেলন থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, তার দল এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে।

ইমরান খান এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তেজনার সূত্রপাত ২০২২ সালে, পিটিআই সরকারের পতনের কিছুদিন আগে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা তার তীব্রতা বাড়িয়ে তোলে।

ক্ষমতার শেষের দিকে ইমরান খান তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সমালোচনা শুরু করেছিলেন। মীর জাফর ও মীর সাদিকের মতো শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি তার সম্পর্কে ব্যবহৃত শব্দ এবং তার গোপন অর্থও প্রকাশ্যে আসতে থাকে।

ইমরান খান যখন বুঝতে শুরু করেছিলেন যে অনাস্থা প্রস্তাব সরকারের পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তখন তিনি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন।

সরকারের পতনের পরে, উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং তারপরে ৯ মে এই দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা একটা নতুন মোড় নেয়।

পিটিআইয়ের নিরাপত্তাহীনতা এবং পরের বছরের চৌঠা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া ওই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের এক ঘটনা সেই আগুনে ইন্ধন যোগ করে।

সাম্প্রতিক সময়ে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, তার বোন, দলের কয়েকজন নেতা এবং খাইবার পাখতুনখোয়ার নতুন মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ স্থগিত করার খবরও সেই দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনার কথাই তুলে ধরেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যও প্রকাশ্যে এসেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে পাকিস্তানের দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সেই দেশেরই জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলার বিষয়টা কী ইঙ্গিত দেয়? এই প্রশ্নের উত্তরে আম্মার আলী জান বলেন, ‘দেশপ্রেম, দেশবিরোধী, দেশবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, দুর্নীতি- এই সবকিছুই প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া এই কথাগুলোর কোনো তাৎপর্য নেই। এটা শুধুমাত্র একটা চলচ্চিত্র যা জনগণকে বারবার দেখানো হয়।’

‘শুধুমাত্র বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমিত নয়’

রাজনৈতিক নেতারা যখন একে অপরের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ তুলছেন, তেমনই ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠানও সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে, যারা সামরিক প্রতিষ্ঠানের অপছন্দের তালিকায় রয়েছেন।

যাইহোক, সামরিক প্রতিষ্ঠান যখন কোনও রাজনীতিবিদকে, বিশেষত দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে ঘোষণা করে, তখন বিষয়টা কেবলমাত্র রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এর পরিণতি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সমাজকে যে প্রভাবিত করবে সে বিষয়টাও সহজেই অনুমেয় কারণ সামরিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘ মেয়াদী হতে পারে।

কিন্তু এই বিষয়টা বেশ অদ্ভুত যে এক সময় যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অন্য দেশের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করা ও দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাদের পরে 'দেশপ্রেমিক' বলে ঘোষণা করা হয়। হুসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীকেও এক সময় দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে যখন দেশ ভাগ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল, তখন তার মেয়েকে ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় গোলাম ইসহাক খানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

নওয়াজ শরিফকেও দেশের শত্রু ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এখন ইমরান খানকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতিবিদরা যখন একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তখন তারা আসলে একে অপরের রাজনীতির সমালোচনা করেন, কিন্তু ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠান যারা নিজেকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করে তারা কেন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ করছে?

এই প্রসঙ্গে অবশ্য এটাও মনে রাখা দরকার যে সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে তারা বারবার বলেছে যে সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা উচিত। তাহলে কেন এমনটা ঘটছে?

আম্মার আলী জান এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, কারা নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং কারা নয় তা নির্ধারণের ক্ষমতা আইএসপিআর-এর মহাপরিচালককে দেওয়া হয়েছে। আমরা যখন রাষ্ট্র ও দেশপ্রেমের কথা বলি, তখন কোনো একটা প্রতিষ্ঠান বা বিভাগের কাছে নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত নয়। আমরা সবাই পাকিস্তানি এবং মানুষ যদি কাউকে ভোট দেয়, সমর্থন করে বা তার বিরোধিতা করে, তাহলে সেটা জনগণের অধিকার।’

তার মতে এই বিষয়টা উল্লেখযোগ্য যে সামরিক প্রতিষ্ঠান সমস্ত রাজনীতিবিদদেরই ব্যবহার করেছে এবং পরে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে ঘোষণা করেছে। এই মুহূর্তে ঠিক তেমনটাই ইমরান খানের ক্ষেত্রে ঘটছে।

আম্মার আলী যান পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যদি তারা এতটাই বিপজ্জনক ও মন্দ হন, তাহলে আপনারা কেন তাদের সমর্থন করেছিলেন? কেন তাদের সরকারে এনেছিলেন?’বিবিসি বাংলা


এমএইচআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর