এক বছর আগে, শাম তথা সিরিয়ার কসাইখ্যাত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের শাসনের অবসান ঘটে। দেশটির সাধারণ নাগরিকদের অনেকের কাছেই আসাদের শাসনব্যবস্থার পতন এক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে এসেছিল, যা নির্যাতন এবং গুমের জন্য কুখ্যাত ছিল। তারা একটি স্বাধীন ও নিরাপদ দেশের স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে এমনটি হবে কি না তা নিয়ে বাস্তবসম্মত যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের দীর্ঘ শাসনের অবসান ও প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির বর্ষপূর্তি উদযাপনের জন্য রাজধানী দামেস্কের উমাইয়া স্কয়ারসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ সমাগম ঘটেছে।
বিজ্ঞাপন

এদিকে উদযাপনের আড়ালে লুকিয়ে আছে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেদনাদায়ক প্রশ্ন। কারণ এই এক বছরে সিরিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এলেও দেশটি এখনও স্থিতিশীলতা ও পুনর্গঠনের বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর সিরিয়া নতুন করে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি, যা আরব বিশ্বের বহু দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের পর দেখা গেছে। তবে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত সিরিয়ার অর্থনীতির চিত্র ভয়াবহ। ২০১১ সালের পর থেকে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এছাড়াও দেশটির কোটি মানুষের চাকরি, বাসস্থান ও প্রাথমিক সেবার ঘাটতি রয়েছে।
জাতিসংঘের একটি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে, যেমন কিছু অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কিছু স্কুল পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে, অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মান এখনও অত্যন্ত কঠিন। প্রায় ১৮ লাখ সিরীয় অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিকার এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার সিরীয় শরণার্থী দেশে ফিরেছেন, যারা আবাসন ও কর্মসংস্থানের সংকটে ভুগছেন।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও বাশার আল আসাদকে পতনের মুখে ঠেলে দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী— হায়াত তাহরির আল শামের নেতা আহমেদ আল শারা ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশটির রাষ্ট্রযন্ত্র পুনর্গঠন ও বৈশ্বিক পরাশক্তি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
৪৩ বছর বয়সী আল-শারার নেতৃত্বে তার বিদ্রোহী গোষ্ঠী সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে সিরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। একই সঙ্গে তুরস্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক উল্লেখভাবে উন্নতি হয়েছে, এটি সিরিয়ার ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ফেরার হওয়ার লক্ষণ। এতে পশ্চিমাদের বহু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।
জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদার সাবেক কমান্ডার আল-শারা যিনি একসময় ওয়াশিংটনের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় ছিলেন, এমনকি তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পেন্টাগন। সেই আল-শারা গত মাসে হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এটি ছিল ১৯৪৬ সালে সিরিয়ার স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো কোনো সিরীয় প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে সরকারি সফর। ঐতিহাসিক এই বৈঠকটিকে সিরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।

এরআগে গত মে মাসে সৌদি আরবের রিয়াদে দেশটির যুবরাজ মোহম্মদ বিন সালমান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন আল-শারা। এসময় সিরিয়ার ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা পর প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে প্রতিবেশী ইসরায়েলের সঙ্গে সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এদিকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই দক্ষিণ সিরিয়ায় প্রায়ই হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল এবং গোলান মালভূমিতে তাদের দখলদারিত্ব বৃদ্ধি করে।
সিরিয়ার সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে সিরিয়ায় ১ হাজারের বেশি বিমান হামলা এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে ৪০০ টিরও বেশি আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে চলতি নভেম্বর মাসে দক্ষিণ সিরিয়ায় ৪৭টি অভিযান চালিয়েছে দখলদাবাহিনী।
এছাড়াও গত জুলাইয়ে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সুয়েইদা শহরে দ্রুজ জাতিগোষ্ঠী এবং বেদুঈন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কয়েকদিন ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বহু মানুষ মারা যায় এবং নতুন করে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস রয়ে গেছে।
মূলত, আহমেদ আল-শারার ইসলামপন্থী বাহিনী দেশের ক্ষমতা দখল করলেও সবগুলো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর এখনও তার নিয়ন্ত্রণ নেই। সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বেশকিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের দলে বিদেশি সেনা রয়েছে এবং যারা কট্টরপন্থী ইসলামি মতাদর্শের অনুসারী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে শারা পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ আছে। সংখ্যালঘুরা মনে করছেন, সাবেক বিদ্রোহী নেতার নেতৃত্বে সুন্নি-প্রধান রাষ্ট্র তাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তবে সোমবার সকালে দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে ফজরের নামাজ আদায়ের পর এক ভাষণে আল-শারা বলেন, ‘আপনি যত মহানই হোক না কেন, আমাদের পথে দাঁড়াবে না। কোনও বাধা আমাদের থামাতে পারবে না এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা একসঙ্গে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করব।’
সামরিক পোশাকে উপস্থিত থেকে তিনি আরও বলেন, ‘উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে, আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সিরিয়াকে আবার শক্তিশালী করে তুলব। বর্তমান এবং অতীতের মতো পুনর্গঠন করে সিরিয়ার প্রাচীন ঐতিহ্যের মতো পুনর্গঠন করবো।’
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসাদের পতনের এক বছর পরও দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ এবং আসাদ-পরবর্তী অস্থিরতার কারণে দেশটি এখনও একটি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। স্থিতিশীলতা ফেরাতে এবং জনজীবন স্বাভাবিক করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা ও কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রয়োজন।
সূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স, আনাদোলু
এমএইচআর

