পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের মিথ্যাচার থেকে শুরু করে শুল্ক-সংঘাত, সব কিছু মিলিয়ে সম্প্রতি পুরনো 'বন্ধু' ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ বন্ধ করতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের মিথ্যাচার থেকে শুরু করে ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প।
বিজ্ঞাপন
কেন ‘কৌশলগত বন্ধু’ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প?
কখনও ‘অপারেশন সিঁদুর’। কখনও আবার শুল্ক-যুদ্ধ। সঙ্গে বাড়তি পাওনা পাকিস্তান-প্রেম। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় বসার পর থেকে ভারত-আমেরিকার ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ যেন ভেঙে ফেলতে চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আর ঠিক সেই কারণেই ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃতবৎ’ বলে তোপ দেগেছেন ট্রাম্প। একটা সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘বন্ধু’ বলা ট্রাম্পের হঠাৎ কেন এতটা পরিবর্তন? এর নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সারা দুনিয়াকে নিজের আঙুলে নাচাতে চান ট্রাম্প। আর তাই আমেরিকার শর্তে ভারতকে বাণিজ্য চুক্তিতে রাজি করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।
ট্রাম্প চান, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৃষি এবং দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার খুলে দিক নয়াদিল্লি। কিন্তু, মোদি সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, ভারতের কৃষক এবং দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের লোকসান করে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়। ফলে বেজায় চটেছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, পূর্বসূরি বারাক হুসেন ওবামার মতো নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে আগ্রহী ট্রাম্প। সেই কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে গত সাত মাসে অন্তত ছ’টি জায়গায় যুদ্ধ থামাতে তিনি সমর্থ হয়েছেন বলে প্রচার শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করেন ভারতের জন্যই হাতছাড়া হতে বসেছে তার ওই পুরস্কার। পূর্ব ইউরোপের সংঘাতে সমানে ঘি ঢালছে নয়াদিল্লি। ফলে চেষ্টা করেও দু’পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে পারছেন না তিনি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কিনছে নয়াদিল্লি। ট্রাম্পের যুক্তি, এর ফলে মস্কোর উপরে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না।
লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। এর জেরে সংঘর্ষ থামাতে না পারায় নিজের ‘শান্তিকামী’ ভাবমূর্তি গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারছেন না তিনি। গত বছরের নির্বাচনী প্রচারে ক্ষমতায় এলে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প।
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। তখনও কিন্তু মোদিকে ‘বন্ধু’ বলেই উল্লেখ করছিলেন তিনি। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতেই সেই আচরণে সামান্য বদল লক্ষ্য করা যায়। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি ওয়াশিংটনে পৌঁছোনোর ঠিক আগের মুহূর্তে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে বিবৃতি দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মার্কিন পণ্যে বিপুল পরিমাণে শুল্ক নিয়ে থাকে ভারত। নয়াদিল্লি নীতি না বদলালে ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
গত ২ এপ্রিল আরও জটিল হয় পরিস্থিতি। ওই তারিখ থেকে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি চালু করেন ট্রাম্প। ফলে নয়াদিল্লির পণ্যে চাপে ২৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক।
এর পরেই দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা। ফলে ওই আমদানি শুল্ককে স্থগিত রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু, দ্রুত সমঝোতায় না এলে ফের শুল্ক চাপানোর হুমকি সমানে দিতে থাকেন তিনি।
এর পর ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটকসহ ২৬ জন। ওই ঘটনার প্রত্যাঘাত হানতে মে মাসের গোড়াতেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে ভারতীয় সেনা। ফলে টানা চার দিন ধরে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চলে ‘যুদ্ধ’।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি না চাইলেও আসরে নেমে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই পরমাণু শক্তিধরের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ থামাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন বলে ক্রমাগত দাবি করতে থাকেন তিনি।
এর জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেনি পাক সরকার। অন্য দিকে, ট্রাম্পের দাবি মিথ্যা বলে স্পষ্ট করে দেয় ভারত। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এই নিয়ে প্রচার চালানো বন্ধ করেননি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
পেহেলগাম হামলার ঠিক আগে উস্কানিমূলক মন্তব্য করে খবরের শিরোনামে আসেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির।
ঘটনার নেপথ্যে তার হাত থাকার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দাদের একাংশ। কিন্তু, গত জুনে ট্রাম্পের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসের ভোজসভায় যোগ দেন মুনির।
একটি সূত্র দাবি করছে, তার কাঁধে পাকিস্তানে নিজের ক্রিপ্টো ব্যবসার যাবতীয় দায়িত্ব দিতে চান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এতে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক আরও কিছুটা খারাপ হয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
জুলাইয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধানী ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা ন্যাটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) প্রধান মার্ক রাটের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প।
আরও পড়ুন:নিজের কবর খুঁড়লেন ইসরায়েলি জিম্মি
সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ভারত এবং চীনের নাম করে হুমকি দেন তিনি। রাট বলেন, অবিলম্বে রাশিয়ার থেকে তেল কেনা বন্ধ না করলে নয়াদিল্লি এবং বেইজিংয়ের ওপরে চাপবে বড় আকারের শুল্ক।
তার হুঁশিয়ারির দু’দিনের মাথায় গুজরাটের একটি তেল শোধনাগারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
এর পর গত সপ্তাহে রাশিয়ার তেল আমদানির সঙ্গে জড়িত ভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে ট্রাম্প-মোদির দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এমএমএস

