বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

অবরুদ্ধ গাজা কত বড়, কীভাবে জীবন কাটে ফিলিস্তিনিদের?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

অবরুদ্ধ গাজা কত বড়, কীভাবে জীবন কাটে ফিলিস্তিনিদের?
গাজা সিটির সাধারণ দৃশ্য, ২০২২ সালে তোলা ছবি- রয়টার্স

ফিলিস্তিনের অংশ হলেও এর মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অবরুদ্ধ ও স্বশাসিত অঞ্চল গাজা। ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এলাকাটি চারদিক দিয়েই অবরুদ্ধ। গাজাকে পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গাজার ভূখণ্ড ঠিক কত বড়, কীভাবে জীবন কাটে সেখানে বাস করা লাখ লাখ ফিলিস্তিনির?

বিবিসি ২০১৮ সালে এ বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়, ৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় রয়েছে চারটি শহর, আটটি ফিলিস্তিনী শরনার্থী শিবির আর এগারোটি গ্রাম। গাজায় মোট ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি বাস করে। এলাকাটি কড়া প্রহরাধীন এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা।


বিজ্ঞাপন


গাজা ভূখণ্ডের পশ্চিমে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে মিশর এবং উত্তরে, পূর্বে, ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে ইসরায়েল। গাজা ভূখণ্ডের পূর্ব সীমান্ত ইসরায়েলের দখলে এবং সিনাই মরুভূমিস্থ দক্ষিণ সীমান্ত মিশরের দখলে রয়েছে। ১৯৪৮ সাল হতে ১৯৬৭ পর্যন্ত পুরো ভূখণ্ড মিশরের দখলে ছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েলী যুদ্ধে ইসরায়েল এ ভূখণ্ড দখল করে নেয়, যা এখনও ইসরায়েলের দখলে রয়েছে।

gaza_1
বৃষ্টি হলেই পানি জমে গাজায়- ফাইল ফটো/গেটি ইমেজ/বিবিসি

গাজার ইতিহাস ৫০০০ বছরের পুরনো। বিভিন্ন রাজবংশ, সাম্রাজ্য ও মানুষের দ্বারা গাজা শাসিত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে, আবার জনবহুল হয়েছে। মূলত একটি কনানীয় উপনিবেশ, ফিলিস্তিনীদের দখলে আসা, এবং একটি প্রধান শহর হওয়ার আগে এটা প্রায় ৩৫০ বছর ধরে প্রাচীন মিশরীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

গাজার জনবসতি স্থাপনের ইতিহাসটি ৫০০০ বছরের পুরানো, যা এটিকে বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে স্থান করে দিয়েছে। উত্তর আফ্রিকা এবং লেভান্টের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় পথে এর অবস্থান। লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে মশলা বাণিজ্যর পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে গাজা।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ইসরায়েলে জড়ো রিজার্ভ সেনা, যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

গাজা এক সময় মিশরের অধিকারে ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল এলাকাটি দখল করে নেয়। পরে ২০০৫ সালে ইসরায়েল এলাকাটির দখল ছেড়ে দেয়, সেখান থেকে চলে যায় ইসরায়েলি সেনা এবং প্রায় ৭ হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনকারী।

গাজার বর্তমান বাসিন্দাদের বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় বাড়ি ছেড়ে পালানো বা উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধর। অনেকেই এখনো বাস করেন শরণার্থী শিবিরে। তারা এখনো স্বপ্ন দেখেন নিজের হারানো বসতভূমি (যা ইসরায়েলের দখলে) সেখানে ফিরে যাবার।

gaza_2
গাজার হাসপাতালগুলোতে আধুনিক সেবার অভাব রয়েছে- ফাইল ফটো/গেটি ইমেজ/বিবিসি

গাজায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করেন ৫ হাজার ৪৭৯ জন লোক। আগামি কয়েক বছরে সেটা অনেকটাই বাড়বে বলে মনে করা হয়। এখানে মানুষের মধ্যে ব্যাপক দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মধ্যে বাস করে। কঠোর সীমান্ত প্রহরা আর চেক পয়েন্ট পেরিয়ে বাইরে যাবার সুযোগও অতি সীমিত।

গাজার ভেতরে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েল। প্রতিবারই ব্যাপক সংখ্যায় বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে তারা। সীমান্ত নিরাপত্তা লংঘনের কোন রকম চেষ্টাকে ইসরায়েল তার প্রতি সরাসরি হুমকি বলে মনে করে।

আরও পড়ুন: ইসরায়েলের ভেতরে সংঘর্ষে হামাস, কোন দিকে মোড় নিচ্ছে যুদ্ধ?

চিকিৎসার জন্য এখানকার লোকদের আগে মিশরে বা ইসরায়েলের ভেতরে যাওয়ার সুযোগ ছিল - কিন্তু এখন সীমান্তে কড়াকড়ির জন্য ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ওষুধ, বা ডায়ালাইসিস মেশিনের মতো চিকিৎসা যন্ত্রপাতিও এখন গাজায় আসা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

ফিলিস্তিনি স্থাস্থ্য বিভাগ আগেই জানিয়েছিল, বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে বেশ কয়েকটা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল সেন্টার তাদের সেবার স্থগিত করে দিয়েছে।

গাজার লোকেরা কিছু খাদ্য সাহায্য পায়, কিন্তু তা সত্বেও এখানে পাঁচ লাখেরও বেশি লোক মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনাতিপাত করে। আবাসনের ঘাটতিও প্রকট।

gaza_3
নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে মাছও ধরতে পারে না গাজার অধিবাসীরা- ফাইল ফটো/সংগৃহীত

ইসরায়েল-ঘোষিত সীমান্ত-সংলগ্ন প্রায় একমাইলের বাফার জোনে ফিলিস্তিনিরা চাষবাস করতে পারে না। সমুদ্রে তীর থেকে একটা নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গাজার মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতেও পারেন না।

গাজা থেকে রকেট হামলা হলেই ইসরায়েল এই মাছ ধরার এলাকা কমিয়ে দেয়। আর কোন ফিলিস্তিনি জেলে নৌকা সেই সীমার কাছাকাছি এলেই ইসরাইলি নৌবাহিনীর সৈন্যরা প্রায়ই গুলি চালায়।

প্রতিদিন সেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। গড়ে গাজার লোকেরা দিনে মাত্র ছয় ঘন্টা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। বেশির ভাগ বিদ্যুৎ আসে ইসরায়েল থেকে। যা বর্তমান যুদ্ধের কারণে পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। তবে গাজার একটি নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, আর কিছু মিশর থেকে আসে। অনেক লোক ডিজেলের জেনারেটর ব্যবহার করে। তবে সেটি খুবই ব্যয়বহুল।

গাজায় বৃষ্টিপাত হয় খুবই সামান্য। কোন বড় মিঠা পানির জলাধার নেই। গাজার বাড়িগুলোতে পাইপে যে পানি আসে তার সরবরাহ অনিয়মিত। ৯৭ শতাংশ বাড়িকেই নির্ভর করতে হয় ট্যাংকার দিয়ে সরবরাহ করা পানির ওপর।

পয়:প্রণালী ব্যবস্থা হচ্ছে আরেকটি গুরুতর সমস্যা। প্রায় ৯ কোটি লিটার বর্জ্য পাম্প করে ভূমধ্যসাগরে বা খোলা পুকুরে ফেলা হয় - যার ফলে গাজার পানির স্তরের ৯৫ শতাংশই দূষিত। এই রকম পরিবেশের মধ্যেই বাস করছেন গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনি।

gaza_4
বেশিরভাগ সময়ই অন্ধকারে থাকে গাজা- ফাইল ফটো/গেটি ইমেজ/বিবিসি

গাজার জনসংখ্যা ২০১৫ সালের ছিল ৬ লাখ ৩০ হাজার। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ৩১ লক্ষে গিয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হয়।

এই এলাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে- তবে ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হামাস গোষ্ঠী শাসন করতো এই গাজা। হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি আইনসভার নির্বাচনে জয়ী হয়। তারপর প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সাথে সংঘাত সৃষ্টির পর তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

হামাসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর খুব দ্রুত ইসরায়েল এই এলাকাটির ওপর একটা অবরোধ আরোপ করে। গাজা ও ফিলিস্তিনের অন্য এলাকার মধ্যে লোকজন ও পণ্যের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মিশরও গাজার দক্ষিণ সীমান্তে অবরোধ আরোপ করে।

gaza_5
এমন সব সুড়ঙ্গের মাধ্যমে মিশর থেকে পণ্য আসতো গাজায়। সেসব অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে মিশর।- ফাইল ফটো/গেটি ইমেজ/বিবিসি

মিশর ও গাজার মধ্যে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে সে সময় গড়ে ওঠে চোরাচালানের সুড়ঙ্গের এক নেটওয়ার্ক। এগুলো দিয়ে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য মিশর থেকে গাজায় ঢুকতো। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি  রাফাহ সীমান্তে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কগুলোও বন্ধের অভিযান চালায়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া ২০১৪ সালে অক্টোবর থেকেই মিশর গাজা সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছে।

গাজা থেকে সীমান্ত ক্রসিং পার হয়ে ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপরও আছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে এরেৎজ ক্রসিং দিয়ে পারাপার করতো প্রতিদিন ২৬ হাজার ফিলিস্তিনি। আর ২০১৭ সালের প্রথম ৬ মাসে এরেৎজ দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকেছে ২৪০ জনেরও কম ফিলিস্তিনি। যা এখন শূন্যের কোঠায় রয়েছে।

আরও পড়ুন: হামাসের অভিযান: নিখোঁজ ৭৫০ ইসরায়েলি, জিম্মি কত?

গাজার বাসিন্দাদের গড় আয়ও কমে গেছে। ১৯৯৪ সালে গাজার একজন অধিবাসীয় গড় বার্ষিক আয় ছিল ২ হাজার ৬৫৯ ডলার। ২০১৮ সালের  বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, গাজাবাসীর আয় কমে নেমেছে ১ হাজার ৮২৬ ডলারে। ২০১৭ সালের হিসেবে গাজার ৪৪ শতাংশ লোকই বেকার। বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশেরও বেশি।

গাজাং দারিদ্র্যের হার ৩৯ শতাংশ - যা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের তুলনায় দ্বিগুণ। বিশেষ করে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সামাজিক ভাতা না থাকলে এ হার আরও বেড়ে যেতো বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে। ধারণা করা হয় যে গাজার ৮০ শতাংশ লোকই কোন না কোন রকমের সামাজিক কল্যাণভাতার ওপর নির্ভরশীল।

gaza_6
গাজার ম্যাপ- বিবিসি

গাজার স্কুলগুলোর ওপর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার প্রচন্ড চাপের কারণে ৯৪ শতাংশ স্কুলই দু'শিফট করে চলে- একটি সকালে আরেকটি বিকালে।

শনিবার (৭ অক্টোবর) ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা করে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস। এতে এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যাও প্রায় দুই হাজার। অপরদিকে ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় প্রায় ৫০০ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। আহত বহু। ইসরায়েল এরই মধ্যে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এই সংঘাত কত তীব্র হবে সেটি নিয়েই চিন্তা বাড়ছে।

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর