শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

ভারতে দৃষ্টিহীনদের আবাসিক কেন্দ্রে ১২ বছর ধরে ধর্ষণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ভারতে দৃষ্টিহীনদের আবাসিক কেন্দ্রে ১২ বছর ধরে ধর্ষণ
১০ বছর বয়স থেকে দৃষ্টিহীন ওই আবাসিককে ধর্ষন করা হত বলে অভিযোগ - প্রতীকি চিত্র। ছবি: বিবিসি

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় দৃষ্টিহীনদের আবাসিক কেন্দ্রে ১২ বছর ধরে ধর্ষণের মতো ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন বলছে, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে তারা দু’দিন আগে জানতে পারে যে দক্ষিণ কলকাতার এক আবাসিক কেন্দ্র এবং দৃষ্টিহীনদের বিদ্যালয়ের এক নারী আবাসিক শিক্ষার্থীকে গত ১২ বছর ধরে ধর্ষণ করছেন ওই কেন্দ্রের মালিক।

নির্যাতিত নারীর বয়স যখন মাত্র ১০ বছর ছিল, তখন থেকেই ধর্ষণ করা শুরু হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।


বিজ্ঞাপন


একটি আবাসিক কেন্দ্রে কীভাবে দীর্ঘ দিন ধরে এই অত্যাচার চলতে পারল, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। শিশু কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, নজরদারির বড়সড় গাফিলতি তো নিশ্চই ছিল।

“এই ঘটনা জানার পরেই আমরা ওই কেন্দ্রে তল্লাশি চালাই বৃহস্পতিবার রাতে। সেখানে ওই নির্যাতিতা মেয়েটা আমাদের জানায় যে তার যখন ১০ বছর বয়স, তখন থেকেই তাকে ধর্ষণ করে আবাসিক কেন্দ্রটির মালিক। গত ১২ বছর ধরে এই অত্যাচার চলছে তার ওপরে। আমরা ওই কেন্দ্রে থাকাকালীন আরও দু’টি মেয়ে এগিয়ে এসে নির্যাতনের অভিযোগ জানায়। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ আর অন্য ৭৭ জনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা এখন আমাদের নজরদারিতে একাধিক সেফ হোমে রয়েছে। তদন্ত শুরু করেছি আমরা,” বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায়।

জনশিক্ষা দফতরের অনুমোদিত 'হোম'

পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন বলেন, “যে আবাসিক কেন্দ্রে এই ঘটনা হয়েছে, সেটি জনশিক্ষা দফতরের অনুমোদন প্রাপ্ত বিশেষভাবে সক্ষমদের একটি হোম। নারী-শিশু উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ দফতরে নথিভুক্ত ছিল না এটি। আমরা কাল গিয়ে দেখেছি যে ওই আবাসিক কেন্দ্রে অপ্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গেই প্রাপ্তবয়স্করাও ছিলেন। এই আবাসিক কেন্দ্রটির সঙ্গে দৃষ্টিহীনদের একটি স্কুলও চলত। হোস্টেলে আবাসিক রাখার কোনো লাইসেন্স গতকাল এরা আমাদের দেখাতে পারেনি। তদন্ত সবে শুরু হয়েছে।“


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ভারতে উপনির্বাচন: বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ে জিতল ইন্ডিয়া জোট

পশ্চিমবঙ্গে শিশুদের জন্য বেশ কয়েক ধরনের সেফ হোম রয়েছে, যার মধ্যে সরকারি হোম যেমন আছে, তেমনই রয়েছে বেসরকারি হোম, যা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দ্বারা পরিচালিত হলেও সরকারি সহায়তা পায়। এছাড়া সম্পূর্ণ বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন পরিচালিত সংগঠনেরও আবাসিক কেন্দ্র রয়েছে।

শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের কনসাল্ট্যান্ট অরণ্য সেন জানাচ্ছেন, “এ রাজ্যে সরকারি হোমের সংখ্যা ১৮ আর বেসরকারি হোম, যেগুলো নারী-শিশু উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ দফতরের সহায়তা পায়, সেরকম হোম ৫০-এর বেশি। এছাড়া বেসরকারি হোম রয়েছে প্রায় ১০০-এর কাছাকাছি।“

নজরদারিতে গাফিলতি

যে আবাসিক কেন্দ্রে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদে, সুরক্ষিত রাখার কথা, সেখানেই দীর্ঘ দিন ধরে ধর্ষণের মতো অত্যাচার কী করে চলতে পারল, সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন পশ্চিমবঙ্গে শিশু-কিশোরদের সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা।

তারা মনে করছেন, নজরদারিতে বড় ধরনের গাফিলতি ছিল, না হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়।

শিশু-কিশোরদের যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করতে যে চাইল্ড-লাইন ব্যবস্থা আছে, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় তার দায়িত্বে রয়েছেন সুরজ দাস।

তার কথায়, “গাফিলতি তো নিঃসন্দেহে ছিল। নজরদারি থাকলে ১২ বছর ধরে অত্যাচার চলল, অথচ কোনো সরকারি কর্মকর্তা টের পেলেন না? এটা কিছুটা অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে"।

“নারী-শিশু উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ দফতরের আবাসিক কেন্দ্রগুলো ছাড়া জনশিক্ষা দফতরে নথিভুক্ত যেসব আবাসিক কেন্দ্রগুলো আছে, সেখানেও নিয়মিত নজরদারি থাকে। ওই আবাসিক কেন্দ্রে নিশ্চয়ই এত বছরে বহু অফিসার গেছেন। তারা কেন টের পেলেন না, সেটাই আশ্চর্যের,” বলছিলেন সুরজ দাস।

আবাসিক কেন্দ্রটির সঙ্গে দৃষ্টিহীনদের একটি স্কুলও চলত - প্রতীকি ছবি

পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন জানাচ্ছে যে তাদের হোমগুলোতে নিয়মিত নজরদারি চলে, তা বাড়ানোও হচ্ছে। তবে প্রতিদিন প্রতিটি হোমের ওপরে নজর রাখা প্রায় অসম্ভব।

“আমরা তাই মানুষের ওপরে, আবাসিকদের ওপরে আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর ওপরেও ভরসা করি। যেমন এই ঘটনাটা আমাদের নজরে আনে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনই। আমরা মঙ্গলবার বিষয়টা জানতে পারি, বৃহস্পতিবার রাতে আমরা তল্লাশি অভিযান চালাই। যেকোনো ক্ষেত্রেই অভিযোগ পেলেই আমরা সেখানে দৌড়ে যাই,” বলছিলেন সুদেষ্ণা রায়।


কীভাবে নজরদারি চালানো হয়

শিশু-কিশোরদের সুরক্ষিত রাখতে হোমগুলোতে একাধিক স্তরে নজরদারি চলে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সদ্য সাবেক সদস্য প্রসূন ভৌমিক বলছেন, “হোমগুলোর কাজকর্মের ওপরে নজর রাখার জন্য বিনা নোটিসে পরিদর্শন একটা খুব সাধারণ পদ্ধতি। এছাড়াও ডিরেক্টরেট অফ চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ট্র্যাফিকিং এবং শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনও নজর রাখে হোমগুলোর ওপরে। আবাসিক কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ঠিক মতো কাজ করছে কিনা, বা সেগুলো নিয়মিত দেখার জন্য নির্দিষ্ট লোক রয়েছে কিনা, সেসবও দেখা হয়।"

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা চাইল্ড লাইনের কর্তা সুরজ দাস জানান, বর্তমানে যে নজরদারি ব্যবস্থা রয়েছে, তা তিনটি স্তরে চালানো হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে হোমের নিজস্ব কমিটি থাকে, যেখানে কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকেন। এর ওপরের স্তরে জেলাভিত্তিক নজরদারি কমিটি থাকে, যারা প্রতি তিন মাসে একবার পরিদর্শন করে। আর জেলার শিশু সুরক্ষা কমিটি প্রতিমাসে একবার করে হোমগুলোতে যায়। এইসব কমিটির সদস্যরা যখন হোমে যান, আবাসিকদের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন, যাতে প্রকৃত অবস্থাটা জানা যায়। আবার কমিটিতে মনোরোগ বিশ্লেষকরাও থাকেন, কারও মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখলে তারা সেটা খতিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করেন তার কারণ।

নিরাপত্তা সুনিশ্চিত কীভাবে?

শিশু কিশোরদের আবাসিক কেন্দ্রগুলো থেকে অত্যাচারের ঘটনা নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝেই প্রকাশ পায়। ওই সব অত্যাচারের মধ্যে কিশোর কিশোরীদের ওপরে যৌন নির্যাতন, পাচার করে দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়।

“সরকারি হোমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিসিটিভি রয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে আশা করি সবজায়গাতেই সিসিটিভি বসে যাবে। এছাড়া কয়েকটি ক্ষেত্র আছে, যেখানে জোর দিলে আশা করা যায় পরিপূর্ণ নজরদারির ব্যবস্থা করা যাবে। হোমের প্রধান বা মালিক বা অধ্যক্ষদের বিরুদ্ধে সরাসরি যদি কোনো অভিযোগ থাকে, সেটা কমিশনে অথবা চাইল্ড লাইনে কী করে জানাতে পারবে, সেই ব্যাপারে আবাসিকদের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি করা দরকার,” বলছিলেন প্রসূন ভৌমিক।

'আবাসিকদের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি করা দরকার' - প্রতীকি ছবি

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় চাইল্ড-লাইনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিশ্বনাথ সামন্ত শিশু-কিশোর আবাসিক কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কতগুলো পরামর্শ দিয়েছেন।

তার কথায়, “পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এত বড় অপরাধ ঘটা কোনো হোমে অসম্ভব। তবে আগে থেকে ব্যবস্থা নিতে পারলে এরকম অপরাধের পরিকল্পনা কেউ করলেও, তা জেনে যাওয়া সম্ভব। প্রথমেই আমাদের নিবিড় পদ্ধতিতে শিশুদের কাউন্সেলিং করা দরকার, এবং কাউন্সেলরকে নিয়মিতভাবে বদলানোও দরকার। একবার যদি হোমের কাউন্সেলর থাকেন, তো পরের বারের কাউন্সেলিং জেলার চাইল্ড লাইন আরেকবার জেলার শিশু সুরক্ষা কমিটি থেকে নেওয়া যেতে পারে। কোনো আবাসিকের মধ্যে আচার-আচরণ বা দৈনন্দিন কাজে পরিবর্তন দেখলে তা সুকৌশলে জানার চেষ্টা করতে হবে।

বিশ্বনাথ সামন্ত বলেন, “এসব ক্ষেত্রে সবথেকে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে হেলথ ইন্সপেকশন কমিটি। কোনো ঘটনা হয়ে থাকলে তারাই প্রথম টের পাবে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের ওপরে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। শিশুদের মধ্যে থেকেই অন্য আবাসিকদের সম্বন্ধে গোপনে খবরাখবর জানার চেষ্টা করা যায়। নজরদারির জন্য খুব সৎ ও আর্থিক লেনদেনে যুক্ত নন, এমন ব্যক্তির নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং সবশেষে এমন একটি কক্ষ তৈরি করা, যেখানে শিশু-কিশোররা সহজেই মনের কথা খুলে বলতে পারবে।”

আরও পড়ুন: এবার শেখ হাসিনাসহ ১৫ রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন মোদি

তিনি বলছিলেন, “এগুলো রূপায়ন করা যাবে কী না জানি না, তবে আমার প্রায় দেড় দশকের কাজের মধ্যে দিয়ে অনুভব করেছি যে এইসব পদ্ধতিগুলো মেনে চললে শিশু-কিশোর হোমগুলোতে নিরাপত্তা আঁটোসাটো করা যাবে হয়ত।’

সূত্র : বিবিসি

এমইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর