বিশ্বে উন্নত জীবন যাপন ও সমঅধিকারের দেশ বললেই প্রথমে চলে আসে কানাডার নাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ স্বপ্নের এই দেশে অভিবাসী হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। এক সময় কানাডিয়ান হিসেবে পরিচিতি পান তারা। আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয়ব বৃহত্তম দেশ কানাডা। চলুন দেশটি সম্পর্কে জেনে আসি।
কানাডার ইতিহাস
কানাডা উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশে অবস্থিত। দেশটির রয়েছে দশটি প্রদেশ ও তিনটি অঞ্চল। এটি আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এবং উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।
বিজ্ঞাপন
কানাডার অধিকৃত ভূমিতে প্রথম বসবাসের জন্য চেষ্টা চালায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ। পঞ্চদশ শতকের শুরুতে ইংরেজ এবং ফরাসি অভিযাত্রীরা আটলান্টিক উপকূল আবিষ্কার করে এবং পরে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ফ্রান্স দীর্ঘ সাত বছরের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলস্বরূপ ১৭৬৩ সালে উত্তর আমেরিকায় তাদের সব উপনিবেশ ব্রিটিশদের কাছে ছেড়ে দেয়।
১৮৬৭ সালে মিত্রতার মধ্য দিয়ে চারটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয় কানাডা। এর ফলে আরও প্রদেশ এবং অঞ্চল সংযোজনের পথ সুগম এবং ইংল্যান্ড থেকে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। ১৯৮২ সালের কানাডা অ্যাক্ট অনুসারে, দশটি প্রদেশ এবং তিনটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত কানাডা সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আইনগত রাজ্যতন্ত্র উভয়ই মেনে চলে।
রাষ্ট্রের প্রধান রাজা তৃতীয় চার্লস ও সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী। কানাডার সরকারি ভাষা ইংরেজি ও ফরাসি। রাজধানী অটোয়া। কানাডা জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি (তিন কোটি ৮৪ লাখ)। কানাডার অর্থনৈতিক কেন্দ্র টরন্টো, মন্ট্রিয়ল এবং ভ্যাঙ্কুভার। কানাডার প্রধান উৎপাদনশীল ক্ষেত্র পাঁচটি হলো- পেট্রলিয়াম, গ্যাস, খনিজ, কৃষি এবং বস্ত্র।
বিজ্ঞাপন
নাম আসলো যেভাবে
কানাডা নামটি সেন্ট লরেন্স ইরোকোয়াইয়ান শব্দ 'কানাটা' থেকে এসেছে বলে মনে কর হয়। এর অর্থ 'জেলেদের ক্ষুদ্র গ্রাম', 'গ্রাম', অথবা 'বসতি'। ১৫৩৫ সালের দিকে, বর্তমান কুইবেক শহরের স্টেইডাকোনা গ্রামের দিকে পথনির্দশনের সুবিধার্থে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন অভিযাত্রী জ্যাক কার্তিয়ার। কার্তিয়ার 'কানাডা' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন শুধুমাত্র গ্রামটি চিহ্নিত করতেই নয়, বরং গ্রাম্য-প্রধান ডোন্নাকোনা সম্পর্কিত সব কিছু নির্দেশ করতে। ১৫৪৫ সাল নাগাদ ইউরোপের বই এবং মানচিত্রে এই অঞ্চলকে 'কানাডা' হিসেবে নির্দেশিত করা শুরু হয়।
আরও পড়ুন: কেন ভাঙল ট্রুডো-সোফির সংসার?
কানাডায় ফরাসি উপনিবেশকে 'নব্য ফ্রান্স' বলা হতো, যার বিস্তৃতি ছিল সেন্ট লরেন্স নদী থেকে গ্রেইট লেইকসের উত্তর উপকূল পর্যন্ত। পরবর্তীতে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত, এটি যথাক্রমে 'উচ্চ কানাডা' এবং 'নিম্ন কানাডা' নামক দুটি ইংরেজ উপনিবেশে বিভক্ত থাকে।
কানাডা অ্যাক্ট ১৯৮২ অনুসারে, কানাডাই একমাত্র আইনগত এবং দ্বিভাষিক নাম। ১৯৮২ সালে সরকারি ছুটি 'ডোমিনিয়ান ডে' কে পরিবর্তন করে 'কানাডা ডে' করা হয়।
সরকার ব্যবস্থা
কানাডা একটি ফেডারেশন যাতে সংসদীয় গণতন্ত্রভিত্তিক সরকারব্যবস্থা এবং একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রচলিত। কানাডার সরকার দুই ভাগে বিভক্ত। কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকার। প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর তুলনায় প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসনের পরিমাণ বেশি। কানাডার বর্তমান সংবিধান ১৯৮২ সালে রচিত হয়। এই সংবিধানে পূর্বের সাংবিধানিক আদেশগুলো একটিমাত্র কাঠামোয় একত্রিত করা হয় এবং এতে অধিকার ও স্বাধীনতার উপর একটি চার্টার যোগ করা হয়।
এই সংবিধানেই প্রথম কানাডার স্থানীয় সরকারকে তার সংবিধানের উপর পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পূর্বে কানাডা ১৮৬৭ সালে প্রণীত ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকা অধ্যাদেশবলে পরিচালিত হত এবং ব্রিটিশ সরকারকে কিছু সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: বাড়ছে মুসলিমদের সংখ্যা, কেমন দেশ অস্ট্রিয়া
কত বড় দেশ কানাডা
আয়তনের বিচারে কানাডা বিশ্বের ২য় বৃহত্তম রাষ্ট্র। এটি উত্তর আমেরিকা মহাদেশের প্রায় ৪১% নিয়ে গঠিত। শীতলতম দেশ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে কানাডার। উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে ছয়টি সময় অঞ্চল বিদ্যমান। দেশটির আয়তন ৯৯ লাখ ৮৪ হাজার ৬৭০ বর্গকিলোমিটার।
কানাডার জলবায়ুতে গ্রীষ্মকালে হালকা ভ্যাপসা ঠান্ডা, ভিজা কুয়াশা (কিছু সময়ে গরম রৌদ্রসম্পন্ন), শীতকালে ভীষণ ঠান্ডা, বরফাচ্ছন্ন, শুষ্ক এবং তুষারপাত থাকে। এ দেশে প্রতিদিন আর্কটিক বরফাচ্ছন্নের দ্বারা শৈত্যপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। এই জলবায়ুটি রাশিয়ার সমতুল্য। কানাডা রাশিয়ার জলবায়ুর মতো শৈত্যপূর্ণ এবং হিমশীতল। দেশটি বছরে ৮ মাস বরফাচ্ছন্ন থাকে।
অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনী
কানাডা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি। দেশটি অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এবং জি-৮ গ্রুপের সদস্য। অন্যান্য উন্নতদেশগুলোর মত কানাডার অর্থনীতির সিংহভাগ সেবামূলক শিল্প নিয়ে গঠিত। প্রায় তিন চতুর্থাংশ কানাডাবাসী কোন না কোনো সেবা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
কাঠ ও খনিজ তেল আহরণ শিল্প কানাডার প্রধানতম দুইটি ভারী শিল্প। এছাড়া দক্ষিণ ওন্টারিওকে কেন্দ্র করে একটি উৎপাদন শিল্পব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে মোটরযান উৎপাদন শিল্প অন্যতম।
বর্তমান কানাডীয় সামরিক বাহিনী ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিতে এখন প্রায় ৬২ হাজার সদস্য সক্রিয় আছেন। রিজার্ভে আছেন ২৫ হাজার সদস্য, যার মধ্যে রয়েছেন ৪ হাজার কানাডীয় রেঞ্জার্স।
আরও পড়ুন: কানাডায় নাগরিকত্ব পাওয়ার উপায়
কোন ধর্মের মানুষ বেশি
কানাডার জনসংখ্যার ৬৭.২ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারি। ২৩.৯ শতাংশ মানুষ কোনো ধর্ম মানেন না। দেশটিতে ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ৩.২ শতাংশ। এছাড়া হিন্দু ১.৫, শিখ ১.৪ এবং বাকি অংশ বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্মের অনুসারী।
কানাডায় রয়েছে মোট ৫২ হাজার ৪৫৫টি দ্বীপ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো বাফিন দ্বীপ। এর আয়তন ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯২৭ বর্গ কিলোমিটার। তবে মানুষের বসবাস রয়েছে এমন দ্বীপের সংখ্যা অনেক কম। এছাড়া বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি হ্রদ রয়েছে কানাডায়। দেশটিতে হ্রদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি।
অভিবাসীদের প্রিয় দেশ কানাডা
২০১৯ সালের আদমশুমারি অনুসারে, কানাডা বিশ্ব থেকে সর্বাধিক সংখ্যক অভিবাসীকে স্বাগত জানিয়েছে। কানাডার জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ অভিবাসী।
অভিবাসীদের জন্য কানাডা সবচেয়ে পছন্দের দেশ হওয়ার কয়েকটি কারণ হলো-
ক) দেশটি ঘনবসতিপূর্ণ নয় এবং বিদেশিদের স্থায়ী বা অস্থায়ী থাকার জন্য যথেষ্ট ভূমি রয়েছে।
খ) কানাডার জলবায়ুও অনেকের জন্য পছন্দনীয়।
গ) সরকার নাগরিকদের মানসম্পন্ন জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভালো।
ঘ) এছাড়া শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অভিবাসীদের জন্য রয়েছে অবারিত সুযোগ।
সূত্র: কানাডার সরকারি ওয়েবসাইট, সিটিভি ও উইকিপিডিয়া
একে
কানাডা যাওয়ার যোগ্যতা কানাডা সম্পর্কে কানাডার মেয়েদের নাম কানাডা মুসলিম জনসংখ্যা কানাডার আয়তন কত ২০২২ কানাডা কি ইউরোপ কান্ট্রি