বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শীতে বাড়ছে বায়ু দূষণ: নাকমুখ চেপে পথ চলতে হয় নগরবাসীর

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:২০ এএম

শেয়ার করুন:

শীতে বাড়ছে বায়ু দূষণ: নাকমুখ চেপে পথ চলতে হয় নগরবাসীর

রাজধানী ঢাকা সারাবিশ্বে অন্যতম শীর্ষ বায়ু দূষণ কবলিত শহর। শীতের শুরুতে রাজধানীর এ দূষণ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। সড়কে ধুলো-বালুর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার মাস্ক ও নকমুখ চেপে চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বিশেষ করে মেট্রোরেলসহ নির্মাণ কাজ চলছে এমন এলাকাগুলোতে এর মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। উন্নয়ন কার্যক্রম চলতে থাকা এলাকাগুলো যেন ধুলো-বালুর কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকছে। এতে এসব এলাকায় চলাচল করা মানুষের নানাধরনের ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একইসঙ্গে সর্দি-কাশিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০১ ও ২০০-এর মধ্যে বায়ুর মান সূচক ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করা হয়। সেখানে ঢাকার বায়ুমান সর্বদায় এই পর্যায়ে থাকে। এমনকি শীতকালে তা ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়েও চলে যায়। রাজধানীর একাধিক এলাকা ঘুরে এই বায়ু দূষণের ভয়বহ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। একইসঙ্গে সমানুপাতিক হরে বেড়েছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা।


বিজ্ঞাপন


ধুলোর চাদরে আবৃত রাজধানী
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র সেগুনবাগিচায় অবস্থিত জাতীয় প্রেসক্লাব একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রতিদিন হাজার হাজার সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের পদচারণার মুখরিত হয় এই প্রাঙ্গণ। প্রেসক্লাবের ঠিক সামনে মেট্রোরেলের একটি স্টেশনের কাজ চলমান রয়েছে। ফলে নিচের সরু রাস্তায় কোনো রকমে যাতায়াত করছে নগর পরিবহনগুলো। এলাকটি সর্বদায় ধুলো-বালিময় হলেও শীতের শুরুতে তা বহুগুণে বেড়েছে। গাড়ি চলাচলের সাথেই এলকাটি ধুলোর কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এতটাই খারাপ যে অল্প দূরেই কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফলে এলাকাটিতে চলাচল করা মানুষদের জন্য তা বিড়ম্বনার কারণ হচ্ছে।

তারিকুল ইসলাম তারেক নামে এক গণমাধ্যমকর্মী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতিদিনিই নানা কাজে প্রেসক্লাবে আসি। মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এলাকাটি ধুলোর রাজ্যে পরিণত হয়েছে। গত কয়েকদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ার আর পরিবেশ শুষ্ক হওয়ায় এর মাত্রা অনেক বেড়েছে। এদিকে হাঁটাচলা করতে হলে নাকমুখ ডেকে চলতে হয়। কালো প্যান্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুলোয় সাদা হয়ে যায়।’

হাসিব নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগে সিএনজি ভাড়া নেওয়ার জন্য কথা বলতে গিয়ে দেখলাম চালকের চোখে পানি। নেশাগ্রস্থ কিনা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার চোখের এ অবস্থা কেন? সে মেট্রোরেলের স্টেশনের নিচের ধুলোর অবস্থা দেখিয়ে বলল বালুতে চোখ জ্বলছে। আমার নিজেরও একই অবস্থা। সড়কে ধুলো-বালির পরিমাণ অনেক বেশি। মাস্ক পড়েও রক্ষা হচ্ছে না।’

air-pollution


বিজ্ঞাপন


একইচিত্র মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, আব্দুল্লাহপুরসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকায়। এ অবস্থায় জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসাপতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ রোগ নিয়ে রোগী ভর্তির হার বেড়েছে। 

বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
বায়ু দূষণের ফলে দেশের মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণ এবং বিষন্নতার ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক এবং সহজাত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট বা শ্বাসযন্ত্রের অবস্থা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ ইভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণজনিত রোগে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়। একইসঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে বড় নির্মাণ এবং ক্রমাগত যানবাহন চলাচলের এলাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় বায়ু দূষণের অবস্থা হচ্ছে এয়ার কোয়ালিটি নির্দেশিকা থেকে গড়ে ১৫০ শতাংশ বেশি, যা প্রতিদিন প্রায় ১ দশমিক ৭০ শতাংশ ধূমপানের সমতুল্য। মাত্রার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্ব বৃহত্তর ঢাকার ইটভাটার কাছে পাওয়া যায়, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১৩৬ শতাংশ বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মাত্রার তুলনায় পিএমএএসএর সংস্পর্শে এক শতাংশ বৃদ্ধির ফলে একজন ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ভেজা কাশি হওয়ার সম্ভাবনা ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং নিম্ন শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি হতে পারে। বায়ুদূষণ মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মাত্রার উপরে পিএম-২ এর সংস্পর্শ এক শতাংশ বাড়লেই হতাশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।

air-pollution

দূষণের মাত্রা তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইটভাটাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় প্রধান নির্মাণ এবং যানজটের কাছাকাছি বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এছাড়া সিলেট বিভাগ, যেখানে দেশের সবচেয়ে বিশুদ্ধ বায়ু রয়েছে, সেখানেও ডব্লিউএইচও নির্দেশিত জিআই এম ডব্লিউ পিএম-২ ঘনত্বের মাত্রা ৮০ শতাংশ বেশি। এটি প্রতিদিন ১২টি সিগারেট খাওয়ার সমান।

এ অবস্থায় জরুরি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে নিরাময়মূলক যত্ন দেওয়ার জন্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবা প্ল্যাটফর্মের উন্নতি এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রচার অন্তর্ভূক্ত থাকতে হবে। বায়ু মানের ডেটার নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং আরও গবেষণা বায়ু দূষণের স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলো মোকাবিলা করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করতে সহায়তা করবে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। 

প্রতিবেদনে ঢাকা ও সিলেটের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বহিরাঙ্গন বায়ু দূষণের প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব কমানোর জন্য, জনস্বাস্থ্য পরিষেবা এবং প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়ার উন্নতি, বায়ু দূষণের ডেটা মনিটরিং সিস্টেমের উন্নতি, প্রারম্ভিক ওয়েমিং সিস্টেমে বিনিয়োগ এবং আরও গবেষণায় জড়িত করাসহ অবিলম্বে পদক্ষেপের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর