রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা নাজমা আক্তার (ছদ্মনাম)। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী গত কয়েক বছর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। ফলে দীর্ঘদিন নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন তিনি। অসংক্রমক এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে খাবারের মতোই নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করতে হয় তাকে। একবেলা খাবার ছাড়া থাকা সম্ভব হলেও ওষুধ ছাড়া থাকার কথা ভাবতেও পারেন না এই নারী।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রায় চল্লিশ বছর পর্যন্ত আমার তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না। সাধারণ জ্বর-সর্দি হলে কখনও কখনও ওষুধ সেবন করেছি। তবে তা কখনওই নিয়মিত ছিল না। গত ৫ থেকে ৬ বছর আগে আমার উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এর কিছুদিন পর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। এরপর থেকে নিয়মিতই ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছি। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন সময় চিকিৎসক ওষুধ পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তবে ওষুধ নিয়মিতই খেতে হচ্ছে। হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্তই ওষুধ খেয়ে যেতে হবে।’
বিজ্ঞাপন
নাজমার মতো মধ্য বয়স পার করা বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই এ ধরনের ওষুধ নির্ভরশীলতা লক্ষ্য করা যায়। তবে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ঠিক কত শতাংশ মানুষ নিয়মিতভাবে ওষুধ সেবন করেন তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। এ সংক্রান্ত তেমন কোনো গবেষণা তথ্যও পাওয়া যায় না। ফলে নিয়মিত ওষুধসেবনকারীর সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো, বয়োজ্যেষ্ঠদের পাশাপাশি তরুণদের মধ্যেও ইদানিং নিয়মিত ওষুধ গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আতঙ্কের বিষয় হলো, বয়োজ্যেষ্ঠদের পাশাপাশি তরুণদের মধ্যেও ইদানিং নিয়মিত ওষুধ গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তেমনই একজন ২৬ বছর বয়সী তুহিন (ছদ্মনাম)। মগবাজার এলাকার এই বাসিন্দা নিজের নিয়মিত ওষুধ সেবনের কথা জানিয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি ২০১৭ সাল থেকে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমে (আইবিএসে) ভুগছি। এ দীর্ঘ সময়েও আমার আইবিএস পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফলে খাদ্যাভাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনলেও পাশাপাশি আমাকে কিছু ওষুধ খেতে হয়। পরিস্থিতি ভালো হওয়ার একাধিকবার ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করেছি। কিন্তু পুনরায় অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ অবস্থায় বর্তমানে চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত এন্টিডিপ্রেসেন্টসহ ওষুধ সেবন করছি। চিকিৎসক মানসিক চাপ কমানো ও জীবনযাপনের পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব দিয়ে ওষুধও নিয়মিত চালিয়ে যেতে বলেছেন। এ অবস্থায় নিজেকে অনেকাংশেই ওষুধ নির্ভরশীল মনে হয়।’
বিজ্ঞাপন
ওষুধ নির্ভরশীলতা নয়, প্রয়োজনীয়তা
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ওষুধ সেবনের বিষয়টি সবার জন্য একদম নিয়মিত নয়। যাদের প্রয়োজন রয়েছে তারাই শুধু ওষুধ সেবন করে। যেমন ডায়াবেটিস, প্রেশারসহ কিছু রোগ রয়েছে যেগুলো থেকে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করা যায় না। তারাই সাধারণত নিয়মিত ওষুধ সেবন করে। এটাকে ওষুধ নির্ভরশীলতা বলা যায় না, এটা প্রয়োজনীয়তা। তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ খায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে কিছু কিছু অসুস্থতা নিরাময়যোগ্য না, নিয়ন্ত্রণযোগ্য।’
নিয়মিত ওষুধ সেবনকারীর সংখ্যা বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের গড় আয়ু আগের তুলনায় বেড়েছে। অর্থাৎ মানুষ অধিক বছর বেঁচে থাকছেন, দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বয়স বাড়লে কিছু রোগ স্বাভাবিকভাবেই হবে। যেমন: বয়স বাড়ার সাথে সাথে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাড় ক্ষয়, চোখে ছানি পড়াসহ নানা সমস্যা দেখা দেবে। বয়স বাড়লে পুরুষের প্রোস্টেটে সমস্যা, নারীদের বিশেষ কিছু সমস্যা দেখা দেবে। এইগুলো বয়স বাড়লে হবেই। আর এদের বেশিরভাগই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আর তার জন্য তাদেরকে ওষুধ খেতেই হবে। তবে কিছু কিছু ওষুধ হয়তো মানুষ বুঝে বা না বুঝে নিয়মিত খায়। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। বেশিরভাগ প্রয়োজনীয়তার জন্য খায়। ওইটা ছাড়া সে বাঁচবে না। বেঁচে থাকার জন্যই তাকে এই ওষুধ খেতে হয়।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নিয়মিত ওষুধ সেবন আমাদের জীবনে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের জনশক্তি আমাদের সম্পদ। এখন এই জনশক্তি যদি কম বয়সে অসুস্থ হয়ে যায় বিশেষ করে অসংক্রমক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় যা সারাজীবন ভুগায়, তাহলে তা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এই ধরনের রোগগুলো তুলনামূলকভাবে বেড়ে যাচ্ছে । আর যেহেতু এ রোগগুলো পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য না, ফলে তাদের নিয়মিত ওষুধ সেবন করা ছাড়া উপায় নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধ সেবনের বেশ কিছু কারণ আমাদের সমাজে রয়েছে। আমাদের পরিবেশ দূষণ বাড়ছে, খাদ্য, পানি, বায়ু, শব্দ দূষণ নগর জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। এছাড়া মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও সমস্যা রয়েছে। ফলে মানুষ বেশি বেশি অসুস্থ হচ্ছে এবং ওষুধ খাচ্ছে। এটা আমাদের ভবিষ্যতকে শঙ্কায় ফেলছে। নিয়মিত ওষুধ সেবন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিকভাবে এসব ওষুধের দাম বেড়েছে। একজন মধ্যবিত্ত ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যেও এ ব্যয় বহন করা অত্যন্ত কঠিন। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তো তা প্রায় অসম্ভব। তাই আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে।’
চিকিৎসকরা কী অধিক ওষুধ পরামর্শ দেন?
জানতে চাইলে আধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘কিছু চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ওষুধ প্রেসক্রাইব করার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময় এ ধরনের অভিযোগ উঠে। যদিও তা সম্পূর্ণভাবে তথ্য নির্ভর নয়। সবাই এমন করেন তা নয়, কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এটি আসলে সেই চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার উপর নির্ভর করে। আমাদের কারিকুলামে কিছু সমস্যা রয়েছে। যেটা আমরা বলি যে, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার এমবিবিএস পর্যায়ে কাউন্সিলিংটা ওইভাবে চালু হয়নি।’
অধিক ওষুধের ব্যবহারে ওষুধ কোম্পানিগুলো এগ্রেসিভ মার্কেটিংয়ের প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলোর মার্কেটিংকে সরাসরি দায়ী করার সুযোগ নেই। এটি ঠিক নয় বলে মনে করি। চিকিৎসকরা রোগীর প্রয়োজনীয়তা বুঝে ওষুধ পরামর্শ করেন।’
তবে অধ্যাপক বেনজির চিকিৎসকদের অধিক ওষুধ প্রেসক্রাইবের ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানির এগ্রেসিভ মার্কেটিংয়ের দায়ী বলে উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘ওষুধ শিল্প আমাদের একটি গর্ভ। কিন্তু এখন সেটা আমাদের জন্য কিছুটা বিপদের কারণ হয়েও দাঁড়াচ্ছে। এই যে এত এত ওষুধ কোম্পানি, ফলে তাদের মান কতটা রক্ষা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যে সংস্থার, তাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। মনিটরিংয়ের পুরোপুরি সক্ষমতাও সংস্থাটির নেই। ফলে এটি ক্যান্সারাল গ্রোথের মতো হয়ে যাচ্ছে। বিক্রয় বৃদ্ধির জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিনিধিদের অনেক বেশি চাপ দিচ্ছে। ফলে তারা পাগলের মতো ওষুধের বিক্রয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা চিকিৎসকদের অনৈতিক প্রস্তাব দিচ্ছেন এবং মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট করছে। এতে অনেক চিকিৎসকও সাড়া দিচ্ছেন। ফলে সাধারণ রোগের ক্ষেত্রেও অনেকে ১০ থেকে ১২টি ওষুধ প্রেসক্রাইব করছে।
এমএইচ/এএস