রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চিকিৎসকদের চেষ্টায় বিচ্ছিন্ন ২ হাত ফিরে পেলেন তাসফিন

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৪ পিএম

শেয়ার করুন:

T
অস্ত্রোপচারের পর বিচ্ছিন্ন হওয়া দুই হাত ফিরে পেয়েছেন টঙ্গীর যুবক তাসফিন ফেরদৌস।
বিশ্বে বিরল অস্ত্রপচার
২১ ঘণ্টা পর বিচ্ছিন্ন হাত প্রতিস্থাপন
ছয় ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে সফলতা

দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের কোপে দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়েছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী তাসফিন ফেরদৌস। ২১ ঘণ্টা পর দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে তার সেই হাত জোড়া লাগিয়ে বিশ্বে বিরল নজির সৃষ্টি করেছেন রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা। 


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে তাসফিন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাবেন তিনি। 

বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, প্লাস্টিক সার্জারিতে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় নতুন মাইলফলক তৈরি হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় পর বিচ্ছিন্ন হাতের সফল পুনঃস্থাপন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিরল এবং বাংলাদেশে এই ধরনের বিচ্ছিন্ন হাত প্রথম জোড়া লাগানো হলো।

জানা গেছে, গত ৯ নভেম্বর গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তাসফিন। পথে দুর্বৃত্তরা তাকে ঘিরে ধরে মোবাইল ও ম্যানিব্যাগ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাসফিন বাধা দিতে গেলে দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের কোপে দুই হাত তালু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 


বিজ্ঞাপন


সে সময় পথচারীরা তাসফিনকে উদ্ধার করে স্থানীয় টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনা শুনে তাসফিনের পরিবারের সদস্যরা দ্রুত তাকে রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসেন। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছাতে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় পার হয়ে যায়। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

হাসপাতালে আনার পর সংশ্লিষ্টরা জানান, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এরপর পরিবারের অনুমতি নিয়ে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. শরিফুল ইসলাম শরীফের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক হাতে অস্ত্রোপচার শুরু করেন। এতে চিকিৎসকরা তাসফিনের হাত সফলভাবে পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হন।

মেডিকেল টিমে ছিলেন- বার্ন ইনস্টিটিউটের ডা. সাইফুল ইসলাম, ডা. নবীনা, ডা. সাফিয়া, ডা. মিজানুর রহমান, ডা. আরিফ, ডা. মুক্ত, ডা. স্বর্ণা, ডা. জুবায়ের, ডা. নুসরাত ও অজ্ঞান বিশারদ ডা. তুর্য।

ডা. শরিফুল ইসলাম শরীফ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতিস্থাপন দেশ-বিদেশ সবখানে হয়। আমরা যেটা করেছি সেটা খুবই বিরল। ছয় বা আট ঘণ্টা পরই প্রতিস্থাপন করতে হয়, আমরা করেছি ২১ ঘণ্টা পর। যখন রোগী আসছিল, তখন মনে হয়েছিল রোগী মরে যাচ্ছে। শুরুতে আমাদের প্রথম চিন্তা ছিল রোগীকে বাঁচাতে হবে। রোগীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর প্রতিস্থাপন শুরু করি। বাংলাদেশে এই ধরনের রেকর্ড নেই, তবে বিশ্বেও খুবই কম, অল্প কয়েকটি আছে।’

burn-institute-4
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট।

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে খুবই দ্বিধা-দ্বন্দে ছিলাম যে, পরিশ্রম বৃথা যাবে। সবকিছু মাথায় রেখে আমরা প্রতিস্থাপনের কাজটা শুরু করি। অনেকেই বলেছিল এটা করে লাভ নাই, সময়টা নষ্ট হবে। অন্য কাজে সময়টা দিলে তার থেকে ভালো হবে। তবুও আমি চিন্তা করলাম, চেষ্টা করি, দেখি পারি কি না। দীর্ঘ চেষ্টার পর কাজটা সফলভাবে করতে পেরেছি।’

বিরল সফল অস্ত্রোপচারে পর অনুভূতি জানতে চাইলে ডা. শরিফুল ইসলাম শরীফ বলেন, ‘এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটি পুরো প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের পরিশ্রমের ফসল। আমরা সাধারণ বইপত্রের জ্ঞান অনুযায়ী অস্ত্রপচার করি, আর এটি ছিল সম্পন্ন বইপত্রের বাইরে গিয়ে। আমার খুবই গর্ব অনুভূত হচ্ছে এই ভালো কাজটি করতে পেরে।’

তিনি আরও বলেন, তাসফিন বর্তমানে আইসিইউ থেকে সাধারণ ওয়ার্ডে আছেন, ভালো আছেন। আমরা তাকে দুই-একদিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেব। পরবর্তীতে তাকে ফলোআপে থাকতে হবে এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।’

এ বিষয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশে নতুন নয়। চার-পাঁচ বছর ধরে অল্প করে করা হচ্ছে। যারাই করছেন, সবাই প্লাস্টিক সার্জন। হাত কেটে যাওয়া মানে শুধু রক্তনালি কেটে যাওয়া নয়, রক্তনালি হচ্ছে প্রধান। অন্যান্য সব কিছু জোড়া লাগালেন, তবে রক্তনালি ফেল করলে মৃত্যুর হাত বাঁচবে না।’

তিনি বলেন, ‘শরীরের একটা অঙ্গ যদি বিচ্ছিন্ন হয়, আর যদি রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তবে ছয় ঘণ্টা পর থেকে রোগী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। বিচ্ছিন্ন হাত জোড়া লাগাতে হলে ছয় ঘণ্টার মধ্যে হলে ভালো হয়। এরপর থেকে যত দেরি হবে, সম্ভাবনা তত কমতে থাকে। জোড়া লাগাবেন, কিন্তু রক্ত প্রবাহ চালু হবে না।’

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ওই লোকের (তাসফিন) যখন হাত কেটে যায়, তখন প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় এবং তিনি শকে চলে যান। তখন তার জীবন বাঁচানোটা প্রথম উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের কাছে প্রথম যখন এসেছিল, তখন প্রথম চিন্তা ছিল বাঁচাতে হবে। চিকিৎসা দেওয়ার পর রাতের মধ্যে রোগীটা ভালো হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আসে।’

ডা. নাছির উদ্দিন আরও বলেন, ‘২১ ঘণ্টা পর আমরা হাতটা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করি। এটা খুবই অস্বাভাবিক এবং জোড়া লাগার সম্ভাবনা কম ছিল। এরকম হাত লাগানোর নজির আছে, তবে কম।’

ভুক্তভোগী যুবক তাসফিন ফেরদৌস বলেন, ‘আমি কখনোই কল্পনা করিনি আমার সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই হাত ফিরে পাবো। এখন সেই ভয়াবহ সময়ের কথা মনে পড়লে ভয়ে কেঁপে উঠি। এমন অভিজ্ঞতার শিকার হবো কখনো ভাবিনি। ডাক্তারদের চেষ্টা ও আল্লাহর ইচ্ছায় আমার এই হাত সচল হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আশা করছি।’

তাসফিনের মা আফরোজা সুমি বলেন, ‘আমরা প্রথমে ওর হাতও খুঁজে পাইনি। টঙ্গী হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকায় আনতে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার পর ওর হাত খুঁজে পাওয়া যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভাবছি আমার ছেলে আর বেঁচেই থাকবে না। এখন তার হাত যে আগের মতো ভালো হচ্ছে, এটা আল্লাহর নেয়ামত আর ডাক্তারদের চেষ্টা। ইনারা এত আন্তরিকতার সঙ্গে দেখবেন আমি ভাবতেও পারিনি।’

এসএইচ/এএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর