শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

স্ট্রোকে বৈশ্বিক মৃত্যুর দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে, বেড়েই চলছে ঝুঁকি

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৪ এএম

শেয়ার করুন:

strok
দেশে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রোকে মৃত্যু ও রোগীর সংখ্যা। ছবি: ঢাকা মেইল

দেশে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রোকে মৃত্যু ও রোগীর সংখ্যা। রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে তরুণ থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী। একইসঙ্গে দেশে স্ট্রোক রোগীদের জন্য নেই যথাযথ চিকিৎসাব্যবস্থা। নানা সংকট আর অপ্রতুলতায় ভুগতে হচ্ছে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের।

স্ট্রোকে বৈশ্বিক মোট মৃত্যুর দুই তৃতীয়াংশই বাংলাদেশের। এত রোগী থাকা সত্ত্বেও ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি ঢাকার মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আছে প্রয়োজনীয় ক্যাথল্যাব। অথচ আক্রান্তের ৪০ শতাংশেরই আট ঘণ্টার মধ্যে ক্যাথল্যাবের সাপোর্ট লাগতে পারে।


বিজ্ঞাপন


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। বিশ্বে প্রতি চারজনের একজনের মৃত্যু হয় স্ট্রোকে। প্রতি মিনিটে ১০ জন স্ট্রোকের কারণে মারা যান। এমনকি ১০০ জন স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর ৪৮ জনই উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। শিশুদের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রতি লাখে ২ থেকে ১৩ জন শিশু স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে স্ট্রোকের অর্ধেক হয় রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে, বাকি অর্ধেক হয় মস্তিষ্কের রক্ত নালি ছিঁড়ে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে। বছরে আক্রান্তদের ১০ থেকে ২৫ ভাগ শিশু স্ট্রোকে মারা যায়। ২৫ ভাগ শিশু বারবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত ৬৬ ভাগ শিশুদের হাত পায়ের দুর্বলতা, খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। স্ট্রোকে আক্রান্ত শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে।

দেশে নেই সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান

দেশে এই মুহূর্তে ঠিক কী পরিমাণ মানুষ স্ট্রোকের শিকার হচ্ছেন সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে সাম্প্রতিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে মারা গিয়েছিলেন ৪৫ হাজার ৫০২ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনে দাঁড়ায়, প্রায় দ্বিগুণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রোক মস্তিষ্কের (ব্রেইন) অসুখ। সচেতনতার ঘাটতি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের প্রবণতা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনসহ নানা কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। কোনো কারণে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্তক্ষরণ বা রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হলে স্ট্রোক হয়। স্ট্রোক থেকে প্যারালাইসিস এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ অধিক ঝুঁকিতে

বর্তমান সময়ে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ স্টোকে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সুমন রানা বলেন, ‘আমরা অনেক সময় বলি, শহরের মানুষের বেশি স্ট্রোক হয়, গ্রামে হয় না। কথাটা ঠিক না। অনেক সময় দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ গ্রামের মানুষেরই স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে।’

আরও পড়ুন

দেশে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক

কম বয়সীদের মধ্যে বাড়ছে স্ট্রোকের ঝুঁকি 

এই চিকিৎসক বলেন, ‘পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ আর অন্যরা ৩৬ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের ৩২ থেকে ৪৫ বছরের সময়ই ৬৪ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে।’

নারীর চেয়ে পুরুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ

নারীর চেয়ে পুরুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি দুই গুণ বেশি। নারী প্রতি হাজারে প্রায় আটজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর পুরুষ প্রতি হাজার ১৪ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকলেও শিশুরাও এতে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রতি বছর স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। ষাটোর্ধ বয়সী স্ট্রোকের রোগী প্রায় সাতগুণ।

strok_2

বাড়ছে কম বয়সী স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কম বয়সী স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালে ভর্তি স্ট্রোকের রোগীদের ২২ শতাংশের বয়স পঞ্চাশের কম। ত্রিশের কম বয়সীর সংখ্যাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। চিকিৎসকরা বলছেন, কম বয়সীরা স্ট্রোক আক্রান্ত হলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার বা মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। স্ট্রোক প্রতিরোধে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ময়মনসিংহে স্ট্রোকের রোগী বেশি

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের গবেষণায় বলা হয়েছে, অন্যান্য বিভাগের তুলনায় ময়মনসিংহ বিভাগে স্ট্রোকের রোগী বেশি। এ বিভাগে প্রতি হাজারে ১৪ দশমিক ৭১ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত। সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে, ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ।

আরও পড়ুন

এসব লক্ষণে বুঝবেন আপনি স্ট্রোক করেছেন

স্ট্রোকের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয়

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন। এ হাসপাতালে মাসে ৬০০ জনের বেশি স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ময়মনসিংহ মেডিকেলের নিউরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দারিদ্র্যের হারও বেশি। এদিকে শিক্ষার হার তুলনামূলক কম। ফলে সচেতনতার অভাব রয়েছে। স্ট্রোক হওয়ার পর রোগী জানতে পারেন যে আগে থেকেই তিনি ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। এছাড়া ধূমপানও একটি কারণ।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ঢাকা ছাড়া কোনো জেলাতেই স্ট্রোকের রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এতে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের সিঁড়ি বারান্দায় মানবেতর জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা। এতে রোগীদের মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যারা স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৪৮ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপের রোগী। অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন ৩৬ শতাংশ রোগী, অতিরিক্ত চর্বি রয়েছে ১৯ শতাংশের, মানসিক চাপের কারণে স্ট্রোক হয় ১৭ শতাংশ রোগীর। সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসও স্ট্রোকের অন্যতম কারণ।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এস জহিরুল হক চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘স্ট্রোক একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। স্ট্রোকের রোগীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সময়। যত দ্রুত সম্ভব, স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘স্ট্রোকের কারণে প্যারালিসিসের (পক্ষাঘাত) মতো মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়, কিছু স্ট্রোকে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। স্ট্রোক হলে শরীরের যেকোনো একদিকে হাত-পা ও মুখমণ্ডল প্যারালাইজ হয়ে থাকে। ব্রেইনের ভেতর স্ট্রোকটা যদি বাঁ দিকে হয়, তাহলে ডান দিকের হাত-পা এবং ডান দিকে স্ট্রোক হলে বাঁ দিকের হাত-পা প্যারালাইজ হয়ে থাকবে।’

গবেষকরা জানান, স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যত তাড়াতাড়ি থ্রম্বোলাইসিস করা যায়, তত বেশি সম্ভাবনা থাকে মস্তিষ্কের ক্ষতি কম হওয়া এবং রোগীর পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পাওয়ার। থ্রম্বোলাইসিস চিকিৎসা পদ্ধতিতে জমাট বাঁধা রক্ত দ্রবীভূত করার জন্য বিশেষ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ হলো মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধা। থ্রম্বোলাইসিস এ জমাট বাঁধা ভেঙে দেয় এবং মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক করে।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর