২০০০ সাল থেকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সাথে লড়ছে বাংলাদেশ। তবে ২৫ বছরে ডেঙ্গুকে জয় করার পরিবর্তে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করেছে সংশ্লিষ্ট খাতগুলো। ২০১৯ ও ২০২৩ সাল ছিল এ লড়াইয়ের টার্নিং পয়েন্ট। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ডের বছর ২০২৩ ছিল মশার বিরুদ্ধ পরাজয়ের এক মাইলফলক। চলতি ২০২৪ সালে সংক্রমণ ও মৃত্যু তুলনামূলক কমলেও তা এযাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও ডেঙ্গু সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে হাসপাতালগুলো। শহুরে জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে গ্রামে। এরই মধ্যে একই মশাবাহী চিকনগুনিয়া ও প্রথম বারের মতো জিকা ছড়িয়েছে দেশে।
ফলে সারাবছরই গণমাধ্যমে ছিল ডেঙ্গুর আধিপত্যের খবর। হাসপাতালে রোগীর চাপ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে রোগীদের বিপত্তি, সরকার পতনের পর স্থান প্রশাসনে স্থবিরতা ভুগিয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের। তবে চলতি বছরে হাসপাতালে সিট সংকট, ডাব-স্যালাইনের সিন্ডিকেট, রোগীদের জিম্মি করে ওষুধের দাম বৃদ্ধির মতো ঘটনা তেমন শোনা যায়নি।
বিজ্ঞাপন
ডেঙ্গুর সামগ্রিক চিত্র
গত পাঁচ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ (২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ঘটেছে চলতি বছরে। আর মৃত্যুর হিসেবে দ্বিতীয়। এর আগে ২০১৯ ও ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৪০৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন এবং ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ২০২৩ সালে মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
অপরদিকে চলতি বছর ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট এক লাখ ৪৯১ জন। যার মধ্যে ৬৩ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৯০ শতাংশ নারী। আর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৯৮ হাজার ৯৮০ জন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৫৬৫ জন মারা গেছেন। যার মধ্যে ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ৩০ শতাংশ পুরুষ।
চলতি বছরে সর্বোচ্চ আক্রান্তের ঘটনা ঘটে অক্টোবর মাসে। ওই মাসে সারাদেশে মোট ৩০ হাজার ৮৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। আর সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটে নভেম্বর মাসে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১৭৩ জন।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া মাস ভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এক হাজার ৫৫ জন, মারা যায় ১৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে মাসে ৬৪৪, জুনে ৭৯৮, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন, আগস্টে ৬ হাজার ৫২১ জন, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার ৯৭, অক্টোবরে ৩০ হাজার ৮৭৯, নভেম্বরে ২৯ হাজার ৬৫২ এবং ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ৯ হাজার ২২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর জানুয়ারিসহ প্রতি মাসেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু দেখেছে দেশবাসী। জানুয়ারিতে ১৬, ফেব্রুয়ারিতে ৫, মার্চে ৬, এপ্রিলে ২, মে মাসে ১২, জুন মাসে ৮, জুলাইয়ে ১৪, আগস্টে ৩০, সেপ্টেম্বরে ৮৭, অক্টোবরে ১৩৫, নভেম্বরে ১৭৩ এবং ডিসেম্বরে এখন পর্যন্ত ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ভর্তিতে এককভাবে সর্বোচ্চ ঢাকা উত্তর, রোগী বেশি ঢাকার বাইরে
গত বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র ছড়িয়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর। এককভাবে সর্বোচ্চ ২১ হাজার ১৩৪ জন রোগী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি মিলিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৮ হাজার ৮৯১ জন। তবে ঢাকা মহানগরীর বাইরে রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ঢাকার বাইরে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশন ছাড়া) ৮ হাজার ৭১৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশন ছাড়া) ১৫ হাজার ২৯৫ জন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৪৫ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশন ছাড়া) ১৮ হাজার ৫৮১ জন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে তিনজন, খুলনা বিভাগে ৯ হাজার ৯২৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ হাজার ৩৪৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩ হাজার ৩৪৪ জন, রংপুর বিভাগে ১ হাজার ৫০৭ জন এবং সিলেট বিভাগে ৩৩৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মৃত্যুর ঘটনায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে এসব রোগীর সবাই ওই এলাকার নয়। এদের একটা বড় অংশ রাজধানীর বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে ওই এলাকায় এসেছিলেন। যদিও এর সঠিক তথ্য নেই। ফলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসেবে ঢাকা দক্ষিণে মারা গেছেন ২৩৬ জন। এছাড়া ঢাকা উত্তরে ১০৩ জন, বরিশাল বিভাগে ৬১ জন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে একজন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি এলাকা ছাড়া) ৫৩ জন, ঢাকা বিভাগে ৫০ জন, খুলনায় ৩৪, ময়মনসিংহে ১৬ জন, রাজশাহীতে ৮ জন, রংপুরে ৩ জন মৃত্যুবরণ করেছে।
শীতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ, সাথে ছিল চিকনগুনিয়া-জিকা
ডেঙ্গুকে বর্ষা মৌসুমের রোগ বিবেচনা করা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় শীতকালেও এর সংক্রমণ অব্যাহত ছিল। পৌষেও প্রতিদিন শত শত মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয়েছে, ঘটছে প্রাণহানিও। এমনকি ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে দেখা গেছে। ডেঙ্গু সংক্রমণে মধ্যেই নতুন করে শঙ্কা বাড়িয়েছে চিকনগুনিয়া এবং জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘চলতি বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে মশা ডিম দিয়েছে। ওই ডিম পূর্ণবয়স্ক মশা হয়ে একজন ডেঙ্গু রোগীকে দংশন করে ভাইরাসটা পেটের মধ্যে নিয়ে সুস্থ লোককে কামড় দিচ্ছে। ভাইরাস বা মশার এই জীবনচক্র সম্পন্ন হতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে। ফলে এই প্রকোপ স্বাভাবিক। এরপর পরিস্থিতি ঠিক হবে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে সংক্রমণ কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করছি। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে থেকে বৃষ্টি শুরু হলে তা বাড়তে থাকবে।’
২০২৩ সালের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু কমলেও ছিল আতঙ্ক
সরকারিভাবে স্বীকার করা না হলেও ২০২৩ সালে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছিল। একইসঙ্গে ওই বছর ঢাকা মহানগরী কেন্দ্রিক ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। ফলে ২০২৪ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ ২০২৩ এর তুলনায় কমে আসলেও উদ্বেগ কাটেনি। বরং যেকোনো মাসে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল।
বিশেষজ্ঞদের কণ্ঠেও ছিল উদ্বেগ। ডেঙ্গুর সংক্রমণকে ওয়েভের সঙ্গে তুলনা করে ২০২৪ সালে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কম হলেও তা উদ্বেগের বলে জানান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বছরের যেকোনো সময়ে ২০২৩ এর সাথে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পার্থক্য কমে আসতে পারে বলেও সতর্ক করেন তারা। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগে আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান এখনও উদ্বেগজনক বলে মত দিয়েছিলেন তারা।
এমএইচ/এএস