বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারণে হয়ে থাকে। এর একটা বড় অংশ হয়ে থাকে স্ট্রোকজনিত কারণে। মৃত্যুতে স্ট্রোকের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতি এক হাজারের মধ্যে প্রায় ১২ জন জীবনের কোনো একটি পর্যায়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। বিশেষত পুরুষ এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার তুলনামূলক বেশি। স্ট্রোকে মৃত্যুর পাশাপাশি স্থায়ী অক্ষমতার শিকার হচ্ছেন একটি বিরাট জনগোষ্ঠী। যার অন্যতম কারণ আধুনিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা।
বাংলাদেশে স্ট্রোকের পরবর্তী চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সুবিধার অভাব এখনও দেশের জন্য বড় একটি স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেও, তাদের সঠিক রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের সুযোগ সীমিত। ঢাকার বাইরে এই সেবা প্রায় নেই বললেই চলে। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় সংস্থাপনগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায়, দূরবর্তী অঞ্চলের রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে, সময়মতো সঠিক সেবা না পেয়ে বহু মানুষ স্থায়ী অক্ষমতার শিকার হচ্ছেন। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে দিয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুতর সীমাবদ্ধতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা ফুটে উঠেছে, যা জনগণের জীবনযাত্রার মানের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বিজ্ঞাপন
স্ট্রোক রোগীদের পুনর্বাসন সেবার পরিধি
বাংলাদেশে স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসন সেবার অবস্থা এখনও খুবই সীমিত এবং কেন্দ্রীভূত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ সেবা ঢাকা এবং বড় শহরগুলোতে সীমাবদ্ধ। বর্তমানে ঢাকাতে কেবলমাত্র দুটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালে অ্যাকিউট স্ট্রোক চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে এবং কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল আংশিক পুনর্বাসন সেবা দিচ্ছে।
এই সেবা প্রধানত সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি), ব্র্যাক এবং কিছু সরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সিআরপি শারীরিক থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে এ সেবা দিয়ে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে পুনর্বাসন পরামর্শ ও থেরাপি সেবা প্রদান করছে, যা দূরবর্তী অঞ্চলের রোগীদের জন্য সুবিধাজনক। তবে এসব সেবার পরিধি তুলনামূলকভাবে ছোট এবং চিকিৎসা ব্যয়ভার রোগীদের নিজেদের বহন করতে হয়। এর ফলে, অধিকাংশ রোগী বিশেষত গ্রামাঞ্চলের রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পুনর্বাসন সেবায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থেরাপিস্টের অভাব এবং আধুনিক সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতা এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। মানসিক পুনর্বাসন সেবার ক্ষেত্রেও ঘাটতি আছে, যা স্ট্রোক পরবর্তী রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের পুনর্বাসন সেবার মান এবং প্রাপ্যতা উন্নত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া এই খাতে গবেষণা ও তথ্য ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে দেশে দীর্ঘমেয়াদী এবং সমন্বিত রিহ্যাবিলিটেশন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, স্ট্রোকের রোগীদের শারীরিক সমস্যা বেশিরভাগ সময় স্থায়ী হয়। রোগীদের এক হাত, দুই হাত বা দুইপা প্যারালাইজড হয়ে যায়। কখনও রোগী ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। তাদের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, দৃষ্টিভ্রম হয়। এ অবস্থায় তাদের পুনর্বাসন অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশে এর অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। রোগীদের স্ট্রোক পরবর্তী সময় যে সেবাগুলো প্রয়োজন তা আর হয়ে উঠে না। স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসায় মাল্টি ডিসিপ্লিনারি লোক প্রয়োজন। রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য সবচেয়ে জরুরি ফিজিওথেরাপি। এর মধ্যে অনেক ধরন রয়েছে। কারও শরীর দুর্বল থাকলে এক ধরনের থেরাপি। কথা বলতে সমস্যা হলে স্পিচ থেরাপি। কিন্তু এই সেবাগুলো আমাদের দেশে খুব একটা সহজলভ্য না।
সুযোগের ঘাটতি ও করণীয় তুলে ধরে তিনি বলেন, কিছু হাসপাতালে এই সুযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল, এমনকি অনেক জেলা শহরেও এ ধরনের সুযোগ নেই। এটা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রাথমিকভাবে স্ট্রোককে বয়স্ক লোকদের সমস্যা ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু ইদানিং তরুণদের মধ্যেও স্ট্রোকের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা অসংক্রমক রোগ। তরুণদের ধূমপানের প্রবণতা এক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এজন্য আমাদের রিহ্যাবিলেটেশন প্রোগ্রাম জরুরি। যেখানে নিউরোলজিস্ট, নিউরোসার্জন, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও ফিজিওথেরাপিস্ট থাকবে। সকলের সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হলে এই অবস্থার উন্নতি হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের (নিনস) ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু ঢাকা মেইলকে বলেন, স্ট্রোকের ক্ষেত্রে পুনর্বাসন একটি ভাইটাল পার্ট। স্ট্রোক চিকিৎসায় আধুনিক অনেক পদ্ধতি রয়েছে। যা আমরা ব্যবহার করি। সময়মতো হাসাপাতালে আসতে না পারাসহ নানা কারণে সব রোগীকে তা দেওয়া সম্ভব হয় না। অর্থাৎ রোগীদের একটা বড় অংশ আধুনিক চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে পুনর্বাসন ওইসব রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন স্ট্রোক রোগীর প্রথমদিন থেকেই পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর একদম স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এখানে তাদের শোয়ার পদ্ধতি থেকে ব্যায়ামের একটি পরিকল্পনা তৈরি করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত অবহেলিত।
সমন্বিত চিকিৎসায় জোর দিয়ে এই স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশে স্ট্রোকসহ অঙ্গহানী ও প্যারালাইজড রোগীদের পুনর্বাসনের সেবা দিয়ে থাকে সিআরপি। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে একটি করে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ রয়েছে যেখানে এ সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে পুনর্বাসনের সেবা দিচ্ছে। কিন্তু এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশে স্ট্রোক পুনর্বাসন কিছু থেরাপিতে সীমাবদ্ধ। অথচ এটি একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। যা পুরোপুরি অবহেলিত। পুনর্বাসনের যে সমন্বিত চিকিৎসা তা দেশের রোগীরা পাচ্ছে না। এ সমস্যা দূর করতে সাব-স্পেশালিটির পরিধি বাড়াতে হবে। সরকার ও বেসরকারি খাত সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।
এমএইচ/এমআর