* বছরে সারাদেশে মৃত্যু দুই লাখ ৭৩ হাজার
* ৮০ ভাগ রোগীর একমাত্র ভরসা হদরোগ ইন্সটিটিউট
বিজ্ঞাপন
* ক্যাথল্যাবের ৭১ শতাংশ এবং সিসিইউর ৫৭ শতাংশই ঢাকায়
* ৮ বিভাগে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ধীরগতি
* রাজধানীর বাইরে রিং ও স্ট্যান্ট বসানো যায় ৮ সরকারি ও দুটি বেসরকারি মেডিকেলে
ছয় মাস বয়সী শিশু আয়ান। পরিবারের সঙ্গে হেসে-খেলে সময় কাটার কথা থাকলেও বর্তমানে শিশুটির স্থান হয়েছে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে। জন্মের দুই মাস পর হার্টে ছিদ্র ধরা পাড় আয়ানের চিকিৎসা চলছে ধারাবাহিকভাবে। এরই মধ্যে অবস্থা খারাপ হওয়ায় তকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে কুমিল্লা থেকে তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়েছে। কেননা, কুমিল্লায় তার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।
বিজ্ঞাপন
আয়ানের মা তাসলিমা বলেন, জন্মের দুই মাস পর আমার ছেলের হার্টে ছিদ্র ধরা পরে। তার সকল ধরনের চিকিৎসা চলছে। তবে বয়স কম হওয়ায় এখনই অপারেশন না করার কথা জানিয়েছে চিকিৎসক। এক থেকে দেড় বছর হলে হার্টে অপারেশন করা হবে জানিয়েছে। কিন্তু আমাদের এলাকায় এই চিকিৎসা নেই। হঠাৎ ছেলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় কুমিল্লা মেডিকেলে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা এখানে পাঠায়। প্রথম দিকে আইসিইউতে ছিল। এখন অবস্থা ভালো হওয়ায় ওয়ার্ডে দিয়েছে।
একই অবস্থা সিরাজগঞ্জের শিমলার। সাত বছর বয়সী এ শিশুর হার্টে দুটি ছিদ্র রয়েছে। সিরাজগঞ্জে বেসরকারিভাবে সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা ব্যয়বহুল। ফলে স্থানীয় চিকিৎসক ঢাকায় এনে দ্রুত অপারেশনের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ঢাকায় এসে কোথায় থাকবেন, সরকারি হাসপাতালে সিট পাবেন কিনা, অপারেশনে কত খরচ হবে ইত্যাদি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে তার পরিবার। শিশুটির এক স্বজন ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢাকায় থাকার মতো তাদের নিকটাত্মীয় নেই। আর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সিট ও অপারেশনের ডেট পাওয়া কঠিন। আর খরচের বিষয় তো আছেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে হৃদরোগের বিশ্বমানের সেবা রয়েছে। কিন্তু প্রাণঘাতী এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। যার সামর্থ্য আছে, সে চিকিৎসা নিতে পারছে। যার সামর্থ্য নেই, সে নিতে পারছে না। হৃদরোগ চিকিৎসায় এনজিওগ্রাম, রিং পরানো, বাইপাস সার্জারি সবই শহর বা রাজধানীকেন্দ্রিক। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক বিভাগীয় শহরেও সুযোগ-সুবিধা নেই। এমনকি সারাদেশে ক্যাথল্যাবের ৭১ শতাংশ এবং সিসিইউর ৫৭ শতাংশই ঢাকায়। কাগজে-কলমে ঢাকাসহ সাত জেলায় পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কথা বলা হলেও ঢাকা বাদে বাকি ছয় জেলায় হৃদরোগ চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি প্রায় সময় নষ্ট থাকার কারণে রোগীরা চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন।
এদিকে সারাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর অস্বাভাবিক চাপ বাড়ছে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এখানে চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। ফলে উচ্চবিত্তদের বড় একটি অংশ বিদেশে যাচ্ছেন। আর দরিদ্র শ্রেণি বহুলাংশেই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রোগটির উন্নত চিকিৎসায় ৮০ ভাগ রোগীর একমাত্র ভরসা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এ অবস্থায় সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়াসহ নানা কারণে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
রাজধানীতে বাড়তি চাপ
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিউট হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ১ হাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে ৯৫ হাজার ২৪ জন ও বহির্বিভাগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৯৬ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে জরুরি বিভাগে ১ লাখ ১৫ হাজার একজন এবং বহির্বিভাগে ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ জন হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে রোগী আরও বেড়ে জরুরি বিভাগে ১ লাখ ৩১ হাজার ৯০৩ এবং বহির্বিভাগে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৮ হয়। গত বছরের বছরে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত জরুরি বিভাগে ৯৬ হাজার ৯৭ জন, বহির্বিভাগে ১ লাখ ৩২ হাজার ৪১৩ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া এসময় আন্তঃবিভাগে ভর্তি হয়েছেন ৬৩ হাজার ৬১১ জন ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ৫১১ জন হৃদরোগী।
ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার বাইরে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং বেসরকারিভাবে চারটি হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো হলো, চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, ইমপেরিয়াল হাসপাতাল ও এভারকেয়ার হাসপাতাল। বেসরকারিভাবে সিলেট ও সিরাজগঞ্জে রয়েছে এই সার্জারির ব্যবস্থা। সরকারিভাবে কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনের (রিং ও স্ট্যান্ট বসানো) ব্যবস্থা রয়েছে ৮ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর বেসরকারিভাবে রয়েছে দুটি হাসপাতালে।
এগুলো হলো- রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা আবু নাসের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বেসরকারিভাবে দিনাজপুরে জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন ও সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা রয়েছে।
আরও পড়ুন
ঢাকার বাইরের রোগীদের চাপ সামলাতে সরকার ২০১৯ সালে ৮ বিভাগে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। তবে তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল তিন বছর। সে অনুযায়ী ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ২০২৪ সালে এসেও শেষ হয়নি প্রকল্পগুলোর কাজ। এখন ২০২৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলেও জানা গেছে।
রাজধানীর বাইরে সেবা সম্প্রসারণের তাগিদ
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ওয়াদুদ চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, হৃদরোগ চিকিৎসা প্রধান প্রতিষ্ঠান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এখানে যেসব চিকিৎসক-শিক্ষক আছেন এবং ছিলেন, তারাই সারাদেশের কার্ডিওলোজি চিকিৎসার অভিভাবক। বর্তমানে সারাদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে ১ হাজার ১০০ জনের মতো কার্ডিওলোজিস্ট এবং প্রায় ২৫০ জন কার্ডিয়াক সার্জান রয়েছেন।
হাসপাতালে বাড়তি চাপের কথা জানিয়ে ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ঢাকার বাইরে হৃদরোগের চিকিৎসা আছে। তবে রোগীদের চাহিদা অনুপাতে তা কম। দিন শেষে রোগীরা ঢাকাতেই আসছেন। ১ হাজার ২৫০ শয্যার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গড়ে ১৫০০ থেকে ১৭০০ রোগী ভর্তি থাকছেন। প্রায় সমান সংখ্যক রোগী প্রতিদিন হাসপাতালটির জরুরি ও বহির্বিভাগে ভিড় করছেন। ঢাকার বাইরে কার্ডিওলোজি চিকিৎসা আশানুরুপ উন্নতি না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে।
অপরদিকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সদ্য সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, একটা ইনস্টিটিউটের ভরসা করলে কোনদিনও হৃদেরোগের চিকিৎসার উন্নতি হবে না। বাইরে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সব সময় ভিড় থাকে। আগেও ছিল, এখনো হচ্ছে। এ কারণ রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল, খুলনায় জনবল এবং সরঞ্জাম কমবেশি থাকলেও সার্জারি চিকিৎসা হচ্ছে না। এই রোগীদের দ্রুত সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে ঢাকার পাশাপাশি বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে হার্টের উন্নতি সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
এমএইচ/এমআর