বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

‘না’ বলেছিল সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক, দেশেই অপারেশনে জীবন রক্ষা রায়হানের

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৯ এএম

শেয়ার করুন:

‘না’ বলেছিল সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক, দেশেই অপারেশনে জীবন রক্ষা রায়হানের

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় দেশবাসী। তবে যাদের আত্মত্যাগে নতুন দিনের সূচনা, সেই অকুতভয় ছাত্র-জনতার অনেকেরই, বিশেষ করে যারা আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন, নতুন দেশে তাদের অনেকের স্বাভাবিক জীবনযাপন অনিশ্চিত। তাদেরই একজন সিলেটের সিলাম পদ্মলোচন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়হান আহমেদ। গত ৫ আগস্ট ষোল বছর বয়সী এ কিশোরের মাথার একপাশে বুলেট ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এতে তার মাথার হাড়ের ছোট ছোট টুকরো ব্রেনের রক্তনালীর সাইনাসে ছড়িয়ে পড়ে।

জীবন বাঁচাতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা নিরাশার কথা জানান। তবে তারা অপারগতা প্রকাশ করলেও হাল ছাড়েনি দেশে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের চিকিৎসকরা। হাসপাতালটির নিউরোসার্জন ডা. মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক গত ৯ সেপ্টেম্বর রায়হানের মাথায় সফল অপারেশন করেন। এতে জীবন সংশয় কেটেছে রায়হানের। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।


বিজ্ঞাপন


রায়হানের বর্তমান শারীরিক অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল। সে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পোস্টঅপারেটিভ-১ এর ৪ নম্বর বেডে ভর্তি আছে। এক সপ্তাহ পর তার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা রয়েছে। তবে তাকে নিয়মিত ফলোআপ ও ফিজিওথেরাপির মধ্যে থাকতে হবে। কেননা, সার্জারি সফল হওয়ায় জীবন রক্ষা পেলেও শরীরের একাংশ প্যারালাইজড এবং কথা শুনতে ও বুঝতে পারলেও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না সে।

সার্জারি ও বর্তমান অবস্থা

ঝুঁকি থাকার পরও রায়হানের সফল অস্ত্রোপচার করা নিউরোসার্জন ডা. মাহফুজুর রহমানের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। রায়হানের সার্জারিতে চ্যালেঞ্জ, শারীরিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হয় তার সাথে।

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, রায়হান সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আমাদের এখানে ভর্তি করানো হয়। সে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিল। তার কমপ্লেক্স ডিপ্রেসড ফ্র‍্যাকচার ছিল। অর্থাৎ গুলি মাথা ভেদ করে বের হয়ে যাওয়ার সময় হাড়ের ভাঙা অংশ ব্রেনের রক্তনালীর সাইনাসে ঢুকে গিয়েছিল। এ অবস্থায় অস্ত্রোপচার না করলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল। আবার অপারেশন থিয়েটারেও মৃত্যু হতে পারে।

ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা ঝুঁকির বিষয়ে তার পরিবারকে জানালে তারা সিঙ্গাপুর বা বাইরের কোনো দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সে অনুযায়ী সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে যোগাযোগ করা হয়। তবে তারা ঝুঁকি ও তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ার শঙ্কা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু আমার দুইটি পয়েন্টে তাদের মতামতের বিষয়ে আপত্তি ছিল। প্রথমমত, এই রোগীর ক্ষেত্রে সার্জারি বাধ্যতামূলক ছিল, এটি ছাড়া তাকে বাঁচানো সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, সার্জারি সফল হলে তার অবস্থার অবশ্যই কিছুটা উন্নতি হবে।

অপারেশনের বিষয়ে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের অপারগতা প্রকাশের পর আমরা রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে এখানে (নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে) সার্জারি করার ইচ্ছে প্রকাশ করি। একইসঙ্গে অপারেশন টেবিলে মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টিও তাদেরকে জানাই। পরে তাদের সম্মতিতে আমি ও আমার কয়েকজন সহযোগী অপারেশনটি করি এবং আলহামদুলিল্লাহ তা সফল হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় আমরা সার্জারি শুরু করি এবং বেলা ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তা শেষ হয়। এর ৩০ মিনিট পরই তার জ্ঞান ফিরে আসে।

Singapore--Dr_Mahfuz

রায়হানের বর্তমান শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, সার্জারির আগেই তার ব্রেনের একটা অংশ ড্যামেজ হয়েছে। ফলে তার শরীরের একটা অংশ প্যারালাইজড, তার কথা অস্পষ্ট। এই সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে সেরে উঠবে। সময়ের ব্যবধানে তা উন্নতির দিকে যাবে কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে সময় বলা যাবে না৷ এক থেকে দুই বছরও লাগতে পারে, আবার পুরোপুরি সুস্থ নাও হতে পারে। এ ধরনের রোগী ভালো ফিজিওথেরাপি পেলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যায়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থেকেই যায়।

এ সময় দেশের চিকিৎসা সেবার ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিউরোসার্জনরা এই ধরনের সার্জারি করতে সক্ষম। তাই জনসাধারণের বিদেশমুখী না হয়ে দেশের চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখা উচিৎ। সার্জারির দক্ষতা প্র‍্যাকটিসের ওপর নির্ভর করে। বিদেশে একজন নিউরোসার্জন তার জীবনদ্দশায় সর্বোচ্চ ৫-৭ হাজার সার্জারি করেন। অথচ আমাদের সিনিয়র নিউরোসার্জনরা ৩০-৪০ হাজার সার্জারি করে থাকেন। আমরা হয়তো প্রযুক্তির দিকে কিছুটা পিছিয়ে, কিন্তু অভিজ্ঞতায় আমরা এগিয়ে। প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও দিন দিন কমে আসছে।

পরিবারের কৃতজ্ঞতা

রায়হানের বাবা নান্নু মিয়া দৈনিক ৪০০ টাকায় স্থানীয় একটি লাইব্রেরি ও স্টেশনারি দোকানে কাজ করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে রায়হান সবার ছোট। দরিদ্র এ পরিবার সরকারি সাহায়তায় উন্নত চিকিৎসা এবং অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল সার্জারি করে ছেলের জীবন বাঁচানোয় ডা. মাহফুজসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত নান্নু মিয়া সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ৫ তারিখে (আগস্ট) গুলি লাগার পর সিলেট ওসামানী মেডিকেলে তার চিকিৎসা করেছি। কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাকে ঢাকা পাঠাতে বলে। তখন এলাকাবাসী ও বিত্তবানদের সাহায্যে আইসিইউ হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসি। ছেলেকে সিঙ্গাপুর নিতে চেয়েছিলাম। তারা মানা করায় এখানেই ডাক্তাররা অপারেশন করে। আমার ছেলেটা এখনও সুস্থ হয়নি। কবে আগের মতো হবে তাও জানি না। তবে এখানকার ডাক্তাররা অনেক করেছে, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে মাহফুজ স্যারের প্রতি।

Singapore--Father-Brother

রায়হানের চিকিৎসার শুরুতে তাদের নিজেদের প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। এরপর সরকার সব চিকিৎসা খরচ বহন করছে বলে জানান নান্নু মিয়া।

রায়হানের সাথে যা ঘটেছিল

কিশোর রায়হান আন্দোলনের শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল। আন্দোলনের পুরোটা সময় নিরাপদ থাকলেও বিজয় উদযাপনই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার।

কি ঘটেছিল রায়হানের সাথে জানতে চাইলে তার ভাই মুজিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ৪ আগস্ট বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমরা (দুই ভাই মুজিব ও রায়হান) সিলাম পদ্মলোচন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করি। পরদিনও একই জায়গায় আন্দোলন শুরু হয়। সেদিন দুপুর ১টার দিকে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেই। কিন্তু দুপুর ৩টায় সরকার পতনের খবরে সে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। এরপর আমরা দক্ষিণ সুরমা থানার পাশে আজাদ চত্বরে আসি। সেখানে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত ছিল। 

তিনি আরও বলেন, বিকেলে বিজয় উল্লাস চলার সময় থানায় হামলা হতে পারে এমন শঙ্কায় ফাঁকা গুলি করে সেখানকার পুলিশ। তবে কয়েকজন পুলিশ সরাসরি গুলি করে। পুলিশ পরিদর্শক ফেরদৌস হাসানের নির্দেশে এসব গুলি চালানো হয় বলে শুনেছি। তাদের গুলিতে সেখানে বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হয়। এ সময় আমার ভাইয়ের মাথায় গুলি লাগে। তাকে এম এ জি ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করাই। ৫ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সে ওই হাসাপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিল। এরপর এলাকার বিত্তবানদের আর্থিক সহযোগিতায় ১৭ তারিখে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসি।

Singapore--Raihan

সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা ‘না’ করে দিলেও ঝুঁকি নিয়ে রায়হানের সার্জারি করায় ডা. মাহফুজুর রহমান ও তার সহযোগীদের প্রতি এ সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মুজিবুর রহমান।

এমএইচ/

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর