রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে বদলি আতঙ্ক!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০২৪, ০১:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

বদলি আতঙ্কে কর্মকর্তাদের ‘ঘুম হারাম’!

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভর করেছে বদলি আতঙ্ক। কে কখন কোথায় বদলির আদেশ পাবেন সেই চিন্তায় অনেকটা ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম। প্রথম সারি থেকে শুরু করে নিচের দিকের কর্মকর্তা সবার মধ্যে কাজ করছে ‘বদলি আতঙ্ক’। অনেকদিন ধরে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা অনেক কর্মকর্তাকেও ‘অদৃশ্য কারণে’ হঠাৎ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বদলি করা হচ্ছে। এতে অধিদফতরের কাজে মন্থর গতি দেখা দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, সুনামের সঙ্গে দীর্ঘদিন বিভিন্ন পদে কাজ করে আসা এক কর্মকর্তাকে হঠাৎ করে বদলি করায় ক্ষোভে নিজে থেকেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়া এই কর্মকর্তা হলেন অধিদফতরের উপপরিচালক (পারসোনাল) জালাল উদ্দিন আহমেদ।


বিজ্ঞাপন


অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি হঠাৎ জালাল উদ্দিনকে ঢাকা থেকে কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যাালয়ের উপপরিচালক পদে বদলি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২৪ জানুয়ারির মধ্যে কক্সবাজার যোগদান না করলে পরদিন থেকে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হবে তাকে।

আরও পড়ুন

ফুরিয়ে আসছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ভাণ্ডার!

স্বাভাবিকভাবে চাকরি করলে বিসিএস ১৮ ব্যাচের এই কর্মকর্তার আরও পাঁচ বছর সময় ছিল। কিন্তু রাগে-ক্ষোভে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আবেদন করেন, যা নিয়ে অধিদফতরের ভেতরে-বাইরে বেশ তোলপাড় চলছে। স্বাভাবিক অবসরের আগে চাকরি ছাড়ায় গত রোববার (৭ জুলাই) ছিল এই কর্মকর্তার শেষ অফিস।

বিদায়বেলায় সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, সরকারি চাকরিতে যা দিয়েছি তার চেয়ে পেয়েছি অনেক। জেনেছি আরও বেশি। দেখেছি কত কী, শিখেছি নিরন্তর, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য হতে খুঁড়ে বের করেছি আত্মবিশ্বাস। আর এ আত্মবিশ্বাস নিয়েই হবে আগামীর পথচলা।


বিজ্ঞাপন


অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের বর্তমান সচিব আজিজুর রহমান যোগদানের পর থেকেই হঠাৎ হঠাৎ এমন বদলির ঘটনা ঘটছে। কোনো অপরাধ না করলেও কিছু কিছু শাস্তিমূলক বদলির ঘটনাও ঘটছে বলে অনেকে জানান।

জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৮০টির মতো বদলি আদেশে প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন অধিদফতর থেকে।

আরও পড়ুন

তীব্র গরমে ঝুঁকিতে ওষুধের কার্যকারিতা

অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বদলি হয়েছেন। এদের মধ্যে অভিজ্ঞ অনেক কর্মকর্তাও রয়েছেন। অভিজ্ঞদের বদলি করায় এখানকার সার্বিক কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। সিনিয়র রেখে জুনিয়র কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়ছে। আবার এক জেলায় বদলি করার দুই মাস না যেতে ফের অন্যত্র বদলির ঘটনাও ঘটেছে এই সময়ে। এসব কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এদিকে এমন বদলির সুযোগে অসাধু কিছু কর্মকর্তা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মহাপরিচালকের দফতরে উড়ো চিঠি দিচ্ছেন। যেখানে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে কারও কারও বিরুদ্ধে। এতে করে সবার মধ্যে বাড়তি আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বলে বেশ কয়েকজন জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপপরিচালক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রত্যেকের মধ্যে দুঃশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। এভাবে তো কাজ করা যায় না। একজন দক্ষ কর্মকর্তা যখন হুট করে অনেকটা পানিশমেন্ট বদলির মতো চিঠি পায় তখন তার কাজের গতি নষ্ট হয়ে যায়। সবাই এমন অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।’

আরও পড়ুন

নীরব ঘাতক: বড় অংশই জানে না উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের কথা

অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ করে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বদলি করার বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে আনা হয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরাগভাজন হওয়ায় অনেকটা শাস্তিমূলক বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের সমস্যার কথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও

প্রতিমন্ত্রীকেও অবহিত করা হয়েছে।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিভাগে হঠাৎ বদলি করে দেওয়া একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, 'পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যাকে পছন্দ হচ্ছে না তাকেই দেশের একপ্রান্তে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। কার ভাগ্যে কখন কী আছে তা কেউ বলতে পারছে না। এভাবে তো কাজ করা কঠিন।'

আলোচিত যত বদলি

অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালককে (আইইএম) ও লাইন ডাইরেক্টর (আইইসি) হঠাৎ করে বদলি করে দেওয়া হয় ময়মনসিংহে। বিভাগীয় পরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) হিসেবে বদলি করে তার জায়গায় ময়মনসিংহ থেকে নিয়ে আসা হয় মীর সাজেদুর রহমানকে।

জানা গেছে, ময়মনসিংহ থেকে সেই বিভাগীয় পরিচালককে কিছুদিনের মধ্যে আবার টাঙ্গাইলের উপপরিচালক করা হয়েছে।

গত বছরের ৯ এপ্রিল অধিদফতরের প্রশাসন ইউনিটের সহকারী পরিচালক (পার-১) মো. আব্দুল মান্নানকে সহকারী পরিচালক হিসেবে চুয়াডাঙ্গায় বদলি করা হয়। এর ছয় মাসের মাথায় মো. আব্দুল মান্নানকে চুয়াডাঙ্গা থেকে বদলি করা হয় খাগড়াছড়ির সহকারী পরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) পদে।

একইদিনে অধিদফতরের উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের উপপরিচালক (স্থানীয় সংগ্রহ) মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ভুঁইয়াকে উপ পরিচালক পদে কিশোরগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে বদলি করা হয়।

আরও পড়ুন

কম বয়সীদের মধ্যে বাড়ছে স্ট্রোকের ঝুঁকি 

ওই বছরের ২ মার্চ একইদিনে বদলি করা হয় তিন কর্মকর্তাকে। অধিদফতরের নিরীক্ষা ইউনিটের উপপরিচালক মর্জিয়া হককে এই ইউনিটের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে বদলি করা হয়। অধিদফতরের অর্থ ইউনিটের উপপরিচালক (হিসাব) মো. এনামুল হককে বদলি করা হয় রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে। আর মাদারীপুরের উপপরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) গোলাম মো. আজমকে বদলি করা হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পদে।

রাজশাহীর বিভাগীয় পরিচালককে আবার রংপুরের পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়।  আর মর্জিয়া হককে প্রথমে নিরীক্ষা ইউনিট থেকে পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ), তারপর পরিচালক করা হয় অডিট ইউনিটের। এরপর আবারও বদলি করে ময়মনসিংহ পাঠানো হয়। 

গত বছরের ১৬ মার্চ টাঙ্গাইলের উপপরিচালক মো. মতিউর রহমানকে বদলি করা হয় অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও লাইন ডাইরেক্টর (পিএমই) পরিকল্পনা ইউনিটে। একই প্রজ্ঞাপনে অধিদফতরের উপপরিচালক (উন্নয়ন) সাবিনা পারভীনকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (এমআইএস) ও লাইন ডাইরেক্টর (এমআইএস-এফপি) পদে বদলি করা হয়।

আরও পড়ুন

লটারির মাধ্যমে রাজউকের ১২১ কর্মচারীকে বদলি

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) সিরাজুল ইসলামকে বদলি করা হয় সহকারী পরিচালক পদে সুনামগঞ্জে। 

গত ১৪ ডিসেম্বর অধিদফতরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (সাপোর্ট সার্ভিসেস এন্ড কো-অর্ডিনেশন) এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিটের ডা. তৃপ্তি বালাকে একই পদের পাশাপাশি আজিমপুরের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত পরিচালক পদে বদলি করা হয়।

এর আগে ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর অধিদফতরের নিরীক্ষা ইউনিটের সহকারী পরিচালক প্রদীপ চন্দ্র রায়কে একইপদে বদলি করা হয় পঞ্চগড়ের জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে।

গত ২৮ মে একদিনে বদলি করা হয় খুলনা ও বাগেরহাটের দুই কর্মকর্তাকে। খুলনা জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শামসুদ্দীন মোল্লাকে খুলনায় বদলি করা হয়। একই পদের বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ের অকিবউদ্দিকে বাগেরহাটে পাঠানো হয়।

একইদিনে ডা. রতন কুমার আগরওয়ালকে বদলি করা হয়। সিনিয়র কনসালটেন্ট (অবস/গাইনী এমসিএইচটিএ (লালকুঠি, মিরপুর থেকে তাকে সহকারী পরিচালক পদে পদায়ন করা হয়। তাকে সংযুক্ত রাখা হয় অধিদফতরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার, পরিবার পরিকল্পনা ফিল্ড সার্ভিস ডেলিভারি প্রোগ্রামে।

আরও পড়ুন

সচিবালয় ক্লিনিকে ২ দিনে বদলি ৭ চিকিৎসক

একই প্রজ্ঞাপনে এমসিএইচটিআই (সিসি), লালকুঠির সহকারী পরিচালক ডা. পীযুষ চন্দ্র সুত্রধরকে নিজ দফতরের পাশাপাশি অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্বে দেওয়ার কথা জানানো হয়।

গত ২৬ মে মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, লালকুঠিতে কর্মরত সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. নাছিমা বেগমকে একই প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় প্রধান (গাইনী ও অবস) পদে পদায়ন করা হয়। গত ২৩ মে শরীয়তপুরের উপপরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) মো. সোহেল পারভেজকে ঢাকায় বদলি করা হয় অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (অর্থ) ও লাইন ডাইরেক্টর (ফিল্ড সার্ভিস ডেলিভারি প্রোগ্রাম) ওপি হিসেবে।

গত ২৯ মে অধিদফতরের পরিকল্পনা ইউনিটের সহকারী প্রধান মতিউর রহমানকে বদলি করা হয় রাঙামাটিতে। জেলার সহকারী পরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) হিসেবে তাকে বদলি করা হয়।

আরও পড়ুন

একযোগে ১৪ জেলায় এসপি বদলি

তথ্যমতে, শুধু জুন মাসে অধিদফতর থেকে বদলির আদেশ হয়েছে ১৭টি। আর চলতি মাসের ৯দিনে বদলির আদেশ হয়েছে চারটি। একইদিনে একাধিক কর্মকর্তাকেও বদলির ঘটনা আছে।

কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আজিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এছাড়া এসব বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক আ ন ম আল ফিরোজের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করলে তিনিও ফোন ধরেননি। পরে দুজনের হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবেদক নামপরিচয় দিয়ে তথ্য জানতে ম্যাসেজ করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

বিইউ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর