মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস: জটিল রোগের ঝুঁকিতে আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২০ এএম

শেয়ার করুন:

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস: জটিল রোগের ঝুঁকিতে আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ
  • শনাক্তের বাইরে অর্ধেকের বেশি রোগী
  • আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে অনিশ্চয়তা
  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেন মাত্র ২০ শতাংশ রোগী
  • অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে চোখ, কিডনি ও হৃদরোগে আক্রান্ত বাড়ছে

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আব্দুল কাদির (ছদ্মনাম) ২০২৩ সালে জুলাইয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরোগের কথা উল্লেখ করা হয়। আব্দুল কাদিরের পরিবারের সদস্যরা তার হৃদরোগের অল্প সমস্যা রয়েছে জানলেও তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে ধারণা করতে পারেননি। গত কয়েক বছর অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে একাধিকবার গ্যাংগ্রিনের সার্জারি করা হয়েছিল তার। এতে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে শুরু করে এক সময় পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কাটা হয়। সর্বশেষ তার ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) ধরা পড়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার কিডনি জটিলতার চিকিৎসা চলছিল। 


বিজ্ঞাপন


আব্দুল কাদিরের ছেলে আমিনুল ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বাবার ডায়াবেটিস সবসময় অনিয়ন্ত্রিত ছিল। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে ওনাকে বোঝাতে চাইলে তিনি উল্টো রাগ করতেন। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে তার একাধিক সার্জারির মাধ্যমে বাম পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। সর্বশেষ কিডনি জটিলতা ধরা পড়ে। তবে এর মাঝে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যা আমাদের ধারণার মধ্যে ছিল না।

দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে। বাকি ৮০ শতাংশ রোগীরই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

আব্দুল কাদিরের মতো অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগ। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করেছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতার মতো অসংক্রামক রোগগুলো। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এসব অসংক্রামক রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসব রোগের প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে ডায়াবেটিস। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে হৃদরোগ, ক্রনিক কিডনি রোগের মতো অসংক্রামক রোগগুলোর ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে রোগী শনাক্ত না হওয়া ও প্রকৃত সংখ্যা না জানায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।

২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে তিন লাখ ডায়াবেটিস রোগীর উপর সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতায় ‘চেঞ্জিং ডায়াবেটিস প্যারামিটার শীর্ষক এক ফলোআপ গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে দেখা যায়, দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে। বাকি ৮০ শতাংশ রোগীরই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গবেষণায় রোগীরা কোন ওষুধ বেশি খায়, তাদের নিয়ন্ত্রণ কেমন রয়েছে, কি ধরনের জটিলাতায় ভুগে এ বিষয়গুলো দেখা হয়েছে।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের প্রকল্প পরিচালক ডা. বিশ্বজিত ভৌমিক ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এবং উন্নত বিশ্বেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের রয়েছে। অর্থাৎ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে একটা বড় গ্যাপ রয়ে গেছে। এটি হচ্ছে মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের যে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সেবাখাতে লোকবল প্রয়োজন তা নেই। আমাদের মতো স্বল্পে উন্নত দেশে হাসপাতালে মাধ্যমে এ সেবা নিশ্চিত সম্ভব না। আমাদের প্রয়োজন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা। 

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফল তুলে ধরে তিনি বলেন, ডায়াবেটিস সাধারণ চোখ, কিডনি, হার্টে আক্রমণ করে। বেশিরভাগ জানতেই পারে না তাদের হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যারা নিয়মিত হাসপাতালে চেক করতে যায় না, তারা যখন সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে যায় তখন তাদের জটিলতাগুলো অনেক বেশি থাকে। ফলে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এসব রোগীদের নার্ভও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথম চোখ এরপর কিডনি ও নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সব থেকে বেশি মৃত্যু হয় হার্টের সমস্যার কারণে। 

অনিয়ন্ত্রিত থাকার কারণ কী?

জানতে চাইলে ডা. বিশ্বজিত ভৌমিক বলেন, প্রথমত মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস বিষয়ক পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। ডায়াবেটিস থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায় না। অর্থাৎ সারাজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। এ অবস্থায় অনেক লোকে ওষুধ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন সেখানে ঘাটতি রয়েছে। ফলে রোগীরা নিয়মিত ফলোআপে থাকছেন না। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে। সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কমিউনিটি ক্লিনিকে রক্তচাপ মাপা ছাড়া তেমন কোনো সেবা পাচ্ছেন না। সেখানে জটিল কোনো রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই। এনডিসি কর্নারে বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রোপার ফলোআপের বিষয়টি হচ্ছে না। ডায়াবেটিস মানে শুধু সুগার মাপা নয়। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে দুই ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, এর মধ্যে কারো কিডনি বা লিভারে সমস্যা থাকলে এ ওষুধগুলো নিতে পারবে না। কিন্তু এই কর্নারে এ পরীক্ষাগুলো করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশে ১৪ শতাংশ বা ১ কোটি ৩১ লাখ মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পরিচালিত ‘স্টেপ সার্ভে’ অনুযায়ী, ১০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এতে সারাদেশে ৮ হাজার মানুষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এনসিডির একটি সার্ভেতে দেখা গেছে, প্রতি ৫ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এতে ১ লাখ লোকের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।

বিনামূল্যে ডায়াবেটিসের ওষুধ প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এনডিসি কর্নারে ডায়াবেটিস ও এ সংক্রান্ত ৭টি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ইনসুলিনও দেওয়া হচ্ছে। সরকার টাইপ-১ বাচ্চাদেরও বিনামূল্যে ইনসুলিন দিচ্ছে। তবে এই রোগীরা অনেক সময় নিয়মিত এনডিসি সেন্টারে আসেন না। ওষুধের সরবরাহ ঠিক থাকলে তাদের এক মাসের ওষুধও দেওয়া হয়। এটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শুরু করাটা একটা বড় প্রদক্ষেপ।
 
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রকৃত রোগীর সংখ্যা কত?

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৪ শতাংশ বা ১ কোটি ৩১ লাখ মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পরিচালিত ‘স্টেপ সার্ভে’ অনুযায়ী, ১০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এতে সারাদেশে ৮ হাজার মানুষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এনসিডির একটি সার্ভেতে দেখা গেছে, প্রতি ৫ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এতে ১ লাখ লোকের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।

এসব অবস্থায় যে সংখ্যাটি বলা হচ্ছে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা তার থেকেও বেশি বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে এখনও অর্ধেক রোগীই শনাক্তের বাইরে রয়েছে। যখন এসব রোগী ধরা পড়ছে, তখন তাদের ৫০ শতাংশেরই চোখ, কিডনি, নার্ভ অথবা হার্টের সমস্যা রয়ে গেছে। এটি হয়েছে দেরিতে শনাক্ত হওয়ার জন্য। 

এ বিষয়ে সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের প্রকল্প পরিচালক ডা. বিশ্বজিত বলেন, সরকারি তথ্য মতে, ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১০ শতাংশ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী ১৪ শতাংশের কথা বলছে। আমাদের পাশাপাশি যারা এ ধরনের জরিপ করেছে, অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এ হারটি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। আমাদের দেশের প্রত্যেকের পরিবারের মধ্যে অন্তত একজনের ডায়াবেটিস রয়েছে। অর্থাৎ যে সংখ্যাটি আমরা বলছি সেটা আসলে প্রকৃত অবস্থা নয়।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর