বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ঢাকা

সুন্নতে খতনায় মৃত্যু কেন?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:০৪ পিএম

শেয়ার করুন:

সুন্নতে খতনায় মৃত্যু কেন?
আয়ান আহমেদ রাফি এবং আহনাফ তাহমিন আয়হাম। ফাইল ছবি

# বড়-ছোট সব সার্জারিকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ
# অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের আগে রোগী ফিট কিনা দেখতে হবে
# দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজন দক্ষ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট
# রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে
# প্রয়োজনের তুলনায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ঘাটতি রয়েছে

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিন আয়হাম। দশ বছর বয়সী প্রাণোচ্ছল আহনাফকে ঘিরে ছিল পরিবারের অনেক স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। তবে এক মূহুর্তেই সকল কিছু বিষাদে পরিণত হয়েছে শিশুটির পরিবারের। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সুন্নতে খতনা করাতে তাকে মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে ভর্তি করা হয়। রাত ৮টায় শিশু আহনাফকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। এর ঘণ্টাখানেক পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।


বিজ্ঞাপন


পরিবারের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও তাকে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়েছে। যে কারণে আহনাফের আর জ্ঞান ফেরেনি। আহনাফের বাবা ফখরুল আলম বলেন, আমরা চিকিৎসককে বলেছিলাম যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। তারপরও আমার ছেলের শরীরে সেটি পুশ করেন ডা. মুক্তাদির। আমি বারবার তাদের পায়ে ধরেছি। আমার ছেলেকে যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। কিন্তু তারা তাই দিয়েছে। আমার সন্তানকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় মুক্তাদিরসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবারই। আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই।

এ ঘটনায় শিশুটির বাবা হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দুইজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রথমিক অবস্থায় তাদের চিকিৎসক বলা হলেও তাদের বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাওয়া যায়নি। ফলে তারা প্রকৃত চিকিৎসক কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ডা. মুক্তাদির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোপেডিক বিভাগের জয়েন্ট ব্যথা, বাত ব্যথা, প্যারালাইসিস বিভাগের চিকিৎসক বলে জানা গেছে। 

4_20240221_125532868
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিন আয়হাম

এর মাত্র কয়েকদিন আগেই রাজধানীর বাড্ডা সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু হয় ৫ বছর বয়সী শিশু আয়ান আহমেদ রাফির। গত ৩১ ডিসেম্বর সার্জারি করার পর টানা সাত দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াইয়ের পর মৃত্যু হয় তার। এ ঘটনায়ও পরিবারের অভিযোগ, শিশুটিকে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হলেও তা তাদের জানানো হয়নি। পরিবারকে না জানিয়েই খাতনার জন্য ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে শিশু আয়ানকে অজ্ঞান করেন চিকিৎসক। কিন্তু পরে আর তার জ্ঞান ফেরেনি। এ অবস্থায় শিশুটিকে সাতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজে থেকে পাঠানো হয় গুলশান-২ ইউনাইটেড হাসপাতালে। এরপর শিশুটিকে পিআইসিইউতে লাইঢ সাপোর্টে রেখে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেখানেই মৃত্যু হয় তার।


বিজ্ঞাপন


সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনাদ্বয়ে অভিযোগের তীর একই বিষয়ে। তা হলো, সুন্নতে খতনা করানোর সময় ফুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ, জ্ঞান না ফেরা এবং অবশেষে মৃত্যু। শত শত বছর যাবত এদেশে সুন্নতে খতনার কাজ করে আসছেন হাজমরা। তারা কোনো প্রকার চেতনানাশক বা অবস করা ছাড়াই এই কাজ করে আসছেন। তবে তা যে একদম নিরাপদ এমন নয়। হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রাতিষ্ঠানিক ও চিকিৎসকদের দিয়ে খতনা করানোর প্রবণতা বাড়ছে। এর মধ্যে এ ধরনের ঘটনা অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। সাধারণ মানুষদের প্রশ্ন, খতনা করাতে কী সত্যিই ফুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করতে হয়? এই মৃত্যুর দায় কার?

খতনা করাতে কী ফুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োজন?

জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর জেনারেল সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, বড় হোক বা ছোট সকল সার্জারিই গুরুত্বপূর্ণ। সুন্নতে খতনা লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েও করা যায় আবার জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়াও ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্য হলো, রোগীকে কোনোভাবে ব্যাথা বা ক্ষতিগ্রস্ত না করা। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলো সঠিক মূল্যায়ন ও ঠিকভাবে সার্জারিটা করা। সার্জারি করা চিকিৎসক, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ আমাদের উচিৎ হলো মূল্যায়ন করে সার্জারিটা করা। সেটা বড় বা ছোট সার্জারি যাইহোক না কেন। সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের মৃত্যুর বিষয়টি তদন্তাধীন বিষয়। এ ঘটনাগুলোতে কোনো ভুল বা অবহেলা হয়েছে কিনা এটা তদন্তের মাধ্যমে বের করতে হবে। 

অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, চার পর্যায়ের অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। এগুলো হলো: জেনারেল, রিজিওনাল, সেডাকশন ও লোকাল। এর মধ্যে রিজিওনাল অ্যানেস্থেসিয়া বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। এর মাধ্যমে কিছু নার্ভ ব্লক করা হয়। যে কোনো অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগে দক্ষ জনবল প্রয়োজন। যে কোনো প্রসেডিউরে জটিলতা দেখা দিতে পারে। যদি এটি ঠিক মতো ম্যানেজ করা যায় তাহলে জটিলতা ও মৃত্যুর হার কমে আসবে। একদম শূন্যে হয়তো নামানো যাবে না। তবে যতটা কমানো যায় তা চিকিৎসক, রোগী ও সার্জারির সফলতার জন্য ভালো। অ্যানেস্থেসিয়া নির্বাচন একটি জটিল সিদ্ধান্ত। কোন রোগীকে কি অবস্থায় কোন অ্যানেস্থেসিয়া দিতে হবে তা রোগীর সক্ষমতা ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট নির্ধারণ করেন।

Hospital_20240108_235923336
৫ বছর বয়সী শিশু আয়ান আহমেদ রাফি

দুর্ঘটনা রোধে করণীয় কী?

অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রোপার ইভালুশনটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো চিকিৎসক তার রোগীকে মারতে চায় না। সবার লক্ষ্য থাকে রোগীকে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা। যেহেতু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া আমার দায়িত্ব, তাই উচিৎ হবে রোগী সার্জারির জন্য ফিট নাকি আনফিট তা নির্ণয় করা। প্রয়োজনে সার্জারি পিছিয়ে দেওয়া। অনেক সময় রোগীর জ্বর, শ্বাসকষ্টসহ নানা সমস্যা থাকে। এজন্য সুন্নতে খতনার মতো ছোট কিংবা ক্যান্সারের মতো বড় সার্জারি যাইহোক সমান গুরুত্ব দিতে হবে। 

এ বিষয়ে অধ্যাপক মাকসুদুল আলম বলেন, অতীতের তুলনায় বর্তমানে আমাদের দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। অনেক ওষুধ আমাদের দেশে পাওয়া যাচ্ছে। অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ ও মনিটরিংয়ের জন্য আমরা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি তা অনেক বেশি আধুনিক ও সব জায়গায় পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলোতে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের আগে রোগীর স্বজন ও রোগীর সাথে কথা বলা হয়। কি ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হবে, কি কি জটিলতা তৈরি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। আমাদের দেশে এখনও এই প্রাকটিস গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তাতে এই প্রাকটিস চালু হওয়া দরকার। 

তিনি আরও বলেন, দেশে ২২০০ থেকে ২৪০০ কোয়ালিফাইড অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের ডিপ্লোমা, এমডি, এফসিপিএস ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ করা চিকিৎসক রয়েছে। দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা সার্জারির গুরুত্বপূর্ণ টিম মেম্বর হিসেবে থাকে। এছাড়া আইসিইউ ম্যানেজমেন্টেও কাজ করে। আমাদের যে পরিমাণ এই বিষয়ে চিকিৎসক প্রয়োজন তার তুলনায় সংখ্যাটা অপ্রতুল। দক্ষ ও যোগ্য হওয়ার পাশাপাশি কাজের স্থান, পর্যাপ্ত সরঞ্জাম থাকতে হবে। দক্ষ জনবল দিয়ে যদি অ্যানেস্থেসিয়া করানো হয় তাহলে জটিলতা অনেকাংশেই হ্রাস করা সম্ভব। এ ধরনের দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম বড় কারণ অতিরিক্ত চাপ। তারা অন্যান্য স্পেশালিটি থেকে অধিক কাজ করেন এবং অধিক স্ট্রেস নিতে হয়।

এমএইচ/এমএইচএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর