দেশে আইনের দুর্বলতা, সামাজিক অসচেতনতা, হয়রানি ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা পুলিশের কাছে যেতে চায় না বলে জানিয়েছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। এ অবস্থায় শতকরা ৮০ ভাগ ধর্ষণের ঘটনায় কোনো মামলা হয় না বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ-২০২৩ উপলক্ষে ‘নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজন যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞাপন
আলোচকরা বলেন, ৮০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনায় কোনো মামলা হয় না। আইনের দুর্বলতা, সামাজিক অসচেতনতা, হয়রানি ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভোক্তভোগী ও তাদের আত্মীয় স্বজনরা পুলিশের কাছে যেতে চায় না। ফলে যৌন হয়রানির মতো সামাজিক ব্যাধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া নারী নির্যাতন সংক্রান্ত সাড়ে ২৭ হাজার মামলা ঝুলে রয়েছে। এজন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দলের কাছে যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত তথ্য উপস্থাপন করেন কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি। তিনি বলেন, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এডুকো বাংলাদেশের সহায়তায় ৭০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং ২৮টি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৬৯৫ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫০২ জন নারী এবং ১৯৩ জন কন্যাশিশু রয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে ৩৪৭ জন নারী এবং ২৪৩ জন কন্যাশিশুসহ মোট ৫৯০ জন আত্মহত্যা করেছে।
এ সময়ে গৃহের অভ্যন্তরে সহিংসতার শিকার হয়েছে ১৭৯ জন নারী এবং ২০ জন কন্যাশিশু। পাচার এবং কিডন্যাপের শিকার ৩২ জন নারী এবং ১৩৬ জন কন্যাশিশু, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ২২জন। এদের মধ্যে ৩৬২ জন নারী এবং ৬৬০ জন কন্যাশিশু। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল আরও ৫৩ জন নারী এবং ১৩৬ জন কন্যাশিশুকে। ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ১৩ জন নারী এবং ৩৪ জন কন্যাশিশু। যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছেন ৩৫২ জন, যার মধ্যে ৯৬ জন নারী এবং ২৫৬ জন কন্যাশিশু।
বিজ্ঞাপন
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, সারাদেশের থানায় বিগত পাঁচ বছরে (২০১৮-২২) ২৭ হাজার ৪৭৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৬০টি। অন্যদিকে ডিএমপির তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে ৩০৪২টি ধর্ষণ মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী ২৪৭০ জন এবং শিশু ৫৭২ জন। তাদের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে শুধু ঢাকা মহানগরীতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীর সংখ্যা মাত্র ২৪ জন।
যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে নাছিমা আক্তার বলেন, আমরা মনে করি, সহিংসতা, যৌন হয়রানীর ঘটনার এই ভয়াবহ বাস্তবতার পেছনে যথাযথ বিচার না হওয়ার বিষয়টি বড় ভূমিকা রাখে। যৌন হয়রানীর ঘটনার বিচারের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে একটি বড় প্রতিবন্ধক। এই সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটি যথাযথ আইন। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা দেশের সকল রাজনৈতিক দলের কাছে যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম মনে করে, সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সকল রাজনৈতিক দলসমূহের নিকট নারী ও কন্যাশিশুদের সমস্যার ব্যাপকতা তুলে ধরা প্রয়োজন। এতে দলগুলো তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহারে নারী ও কন্যাশিশুদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ তুলে ধরে এবং বিজয়ী দল সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে।
এ সময় জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দুই দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, যার মাধ্যমে সকল ধরণের এবং সর্বস্তরে সংগঠিত এ ধরণের সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুরা আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিশুদের জন্য একটি আলাদা অধিদফতর গঠন করা।
এমএইচ/এমএইচএম