কলেরা-বসন্তের মতো রোগগুলো একসময় সারা পৃথিবীতে মৃত্যু ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল। চিকিৎসা শাস্ত্রের আধুনিকায়নের সাথে সাথে এ ধরনের রোগ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর স্থান নিয়েছে ক্যানসার, হৃদরোগের মতো অসংক্রামক ব্যাধি। অসংক্রামক এসব ব্যাধির সাথেই গত কয়েক দশক ধরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জুনোটিক বা প্রাণির মাধ্যমে ছড়ানো কিছু রোগ। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মহামারি করোনা, ইবোলা, সোয়াইন ফ্লো, নিপাহ ভাইরাস তার মধ্যে অন্যতম।
নিপাহ ভাইরাস গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আতঙ্ক তৈরি করছে। এ রোগের ভাইরাসটি সাধারণত বাদুড়ের লালার মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। এছাড়া সংক্রমিত লোকদের কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে সম্ভাব্য বায়ুবাহিত সংক্রমণসহ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে অন্যদের সংক্রামিত করতে পারে। এতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার শতকরা ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ আক্রান্ত প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর শীতকালে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়। তবে সম্প্রতি ভারতের কেরালা রাজ্যে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। রাজ্যটিতে এখন পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন আরও অনেকে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
ভৌগোলিকভাবে ভারত-বেষ্টিত বাংলাদেশে শীতকালে নিপাহর অল্প-বিস্তর সংক্রমণ ঘটে। তবে ভারতে সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ নতুন করে নিপাহর ঝুঁকিতে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত নিপাহ ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের ক্ষমতা এই ভাবনার কারণ। কেননা ভারতে নিয়মিত আসা-যাওয়াসহ নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশে মানুষদের। তবে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কার কথাটি উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের মতে, ভারতের একটি রাজ্যে নিপাহ ভাইরাস ছড়ালেও তাতে আপাতত বাংলাদেশের কোনো ঝুঁকি নেই। একই বক্তব্য স্বাস্থ্য বিভাগের। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে একদমই নেই। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে তারা আসন্ন শীতকালে খেজুরের রস পানের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
নিপাহ ঝুঁকির বিষয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ভারতে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ও আমাদের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা মেইলের সাথে কথা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদের। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২০০২ সাল থেকে নিপাহ ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে। এর প্রায় সবগুলো ঘটনায় খেজুরের রস ও বাদুড়ের সাথে যুক্ত। পরবর্তীতে ম্যান টু ম্যান ট্রান্সমিশনও হয়েছে। খেজুরের রস যেহেতু শীতকালে পাওয়া যায়, তাই নিপাহও ওই সময়েই ছড়ায়। যদি বাদুড় থেকে খেজুরের রস পরে মানুষের মধ্যে ছড়াতে হয়, তাহলে এই মুহূর্তে আমাদের নিপাহ সংক্রমণের সম্ভাবনা নেই।
ভারতে সংক্রমণের উৎস জানা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেখা দরকার কেরেলায় ট্রান্সমিশনটা কিভাবে হচ্ছে। উৎসটা কি সেটা জানার দরকার। উৎস জানা গেলে বোঝা যাবে নতুন করে কোনো ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে কিনা। আক্রান্তের তথ্য জানা যাচ্ছে কিন্তু কিভাবে তারা আক্রান্ত হয়েছে সেটা জানা যায়নি। সেটা জানতে পারলে আমাদের ঝুঁকির বিষয়ে ধারণা করা যাবে।
একই অভিমত স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামের। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস নতুন নয়। আমাদের দেশে এটি অনেকটা সিজনাল রোগ। শীতকালে যখন মানুষ খেজুরের রস খাওয়া শুরু করে, তখন এটি দেখা দেয়। এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কর্মপরিকল্পনা নেওয়া আছে। পিক সেন্টার নির্ধারণ করে নিপাহ নিয়ে আমাদের সার্ভিলেন্স চালু আছে। এ বিষয়ক একটি গাইডলাইনও রয়েছে আমাদের। সে অনুযায়ী যেসব অঞ্চলে নিপাহ ভাইরাস পাওয়া গেছে, সেখানে গাছি ও স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আমাদের আইইডিসিআর ও আইসিসিডিডিআর’বি সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা সংগ্রহ এবং গবেষণা করছে। আমরা সর্বদায় নিপাহ নিয়ে সতর্ক রয়েছি। কারণ এটি উচ্চ সংক্রামক একটি রোগ এবং এর মৃত্যুহারও অনেক বেশি। তবে বর্তমানে আমাদের নিপাহ নিয়ে ঝুঁকি নেই।
সতর্কতার বিকল্প নেই উল্লেখ করে স্বাস্থ্যের এই কর্তা ব্যক্তি বলেন, বর্তমানে ঝুঁকি না থাকলেও নিপাহ নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সার্ভিলেন্স কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। কারো যদি লক্ষণ থাকে তবে তাকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা তাকে আইসোলেট করব। মূল বিষয় হলো, শীতকাল আসছে। কেউ যেন কাঁচা রস না খায় সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
স্থল ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং প্রয়োজন কী?
জানতে চাইলে অধ্যাপক নাজমুল বলেন, এটা সীমান্ত দিয়ে ছড়ায় না। এটি বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। বাংলাদেশে বাদুড়ের গায়ে এটি ইতিমধ্যেই আছে। সুতরাং ভারতের সীমান্ত দিয়ে আসবে বিষয়টি এমন নয়। এটি আমাদের এখানে অনেক আগেই এসে গেছে এবং আছে। বন্দরগুলোতে সন্দেহভাজন রোগীদের সবসময়ই চেক করা হয়। কারো যদি নিপাহ হয়েই যায়, সে কিন্তু বন্দর দিয়ে হেঁটে আসতে পারবে না। কারণ সে থাকে আইসিইউতে। এখন জ্বর হওয়ার সাথে সাথে যদি কেউ চলে আসে তবে তাকে আটকানো যাবে না। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশেই কারো গায়ে জ্বর থাকলে তাকে বিশেষভাবে চেক করা হয় না। করোনাকালে তা বিশেষ অবস্থা হিসেবে করা হয়েছে। আমরা চাইলেই বর্তমানে তা করতে পারব না।
একই মত অধ্যাপক বেনজির আহমেদের। প্রখ্যাত এই সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন নেই। কারণ এটি ছড়ায় বাদুড়ের মাধ্যমে, বাদুড় তো আর ভিসা পাসপোর্ট করে আসবে না। তাছাড়া আমাদের সীমান্ত রয়েছে ভারতে পশ্চিমবঙ্গ ও সেভেন সিস্টার্সের সাথে। কেরালা বা উত্তর ভারতের সাথে আমাদের সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। একমাত্র আমাদের রোগীরা চিকিৎসার জন্য ওইদিকে যায়। ব্যাপকভাবে ম্যান টু ম্যান ছড়ালে তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এটি ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এটি যেহেতু ছোট আউটব্রেক, তাই তাদের মাধ্যমে ছড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম।
এমএইচ/জেএম