শিকড়ের ঘ্রাণ ছড়ানো বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে অন্যতম বাংলা ঢোল। লোকসংগীতের প্রাণ বলা হয় একে। ঐতিহ্যবাহী এই ঢোল বাঁচিয়ে রেখেছে লোকসংস্কৃতিকে। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের আগ্রাসনেও এই শহরে ঢোলের কাঠিকে জীবিকা নির্বাহের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছেন অনেকে।
লোকসংস্কৃতি রক্ষার এই নীরব সংগ্রামীরা বর্তমানে কীভাবে দিনযাপন করছেন তা জানতে যোগযোগ করা হয় ঢোল বাদক নয়নের সঙ্গে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘গান-বাদ্য মূলত মানুষের বিনোদনের জন্য। দেশের পরিস্থিতি ভালো থাকলে অনুষ্ঠানও ভালো চলে। কিন্তু দেশের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিলে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিল্পীদের ওপর। মানুষের মনে যদি আনন্দ না থাকে তাহলে আমাদেরকে দিয়ে কে অনুষ্ঠান করাবেন। দেশ খারাপ থাকলে আমাদের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। এখন কনসার্ট ছাড়া টেলিভিশন, রেডিও আর শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানে ঢোল বাজিয়ে কোনোভাবে চলছে। বর্তমানে মানুষের মনে আনন্দ নেই। আমাদের দিয়ে কে গান করাবে?’
বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন রেখে এই ঢুলি আক্ষেপের সুরে জানান সরকারি স্বীকৃতি পেলেও তেমন কোনো সুবিধা বা সুযোগ মেলে না। তিনি বলেন, ‘গত সরকারের সময় শিল্পকলা একাডেমি থেকে একটি সার্টিফিকেট দিয়েছিল। এরপর আর কোনো প্রশিক্ষণ, সুযোগ সুবিধা পাইনি। শুধু ঢোল বাদক না সব যন্ত্রশিল্পীদের একই অবস্থা। সরকার শুধু শুধু শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি করে রেখেছে সেখানে ৫-৭ বছর ধরে বাপের টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণ নাও। মন চাইলে গান বাজনা শেখো, না চাইলে যাও। শেখার পরে কী করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘শিল্পকলা থেকে পাঁচ বছর ধরে একটা ছেলে-মেয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর তালিম নেওয়ার পর যদি কোনো কাজ না পায়, কোথাও ডাক না পাই তাহলে শিখবে কেন? শিল্পকলা একাডেমি থেকে কী লাভ? ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে সংগীতের ওপর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে মেধাবীরা সুযোগ পায়, কিন্তু আমাদের এখানে পায় না। তাহলে এই স্বীকৃতিরই বা মানে কী?’
বিজ্ঞাপন

অভিযোগের সুরে তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি অনেক প্রোগ্রাম করেই টাকা পাইনি। পাবলিক প্রোগ্রাম তো অনেক পরের কথা। টাকা পাওয়ার কথা ১৫ হাজার টাকা, দিয়েছে ৪ হাজার টাকা। আগামী ডিসেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কা ও চীন সফর আছে। প্রত্যেকের পারিশ্রমিক ধরা হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। এর আগে বিদেশে প্রোগ্রাম করলে পেতাম ৩০-৪০ হাজার টাকা। শ্রীলঙ্কার মতো দেশের প্রোগ্রামে আড়াই লাখ টাকা দিচ্ছে তাহলে আগের অনুষ্ঠানগুলো পেমেন্ট কত ছিল? আমাদের পারিশ্রমিক সরকার সবসময় ঠিকভাবেই দিয়েছে। কিন্তু নিচের লোকের নয়ছয় করেছেন।’

১২ বছর বয়স থেকে ঢোল জীবিকার হাতিয়ার আকাশ আহমেদ কবিরের। ২১ বছর ধরে পেশাদার ঢোল বাদক তিনি। কণ্ঠশিল্পী এবং বাদ্যশিল্পীদের মধ্যে সম্মানে পার্থক্য দেখেন না তিনি। তবে পারিশ্রমিক বিস্তর তারতম্য রয়েছে বলে জানালেন।
আকাশের কথায়, ‘যেখানেই অনুষ্ঠান করি সেখানেই ভালো সম্মান পাই। সংগীতশিল্পী আর যন্ত্রশিল্পী একই। কিন্তু সাধারণ মানুষ আমাদের মধ্যে পার্থক্য করে। পাশাপাশি যারা সংগীতশিল্পী তারা অনেক সুখে থাকেন। জনপ্রিয়তার বিচারে তারা একটি কনসার্ট থেকে ১-৫ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন। কিন্তু যন্ত্রশিল্পীরা এত টাকা পারিশ্রমিক পায় না। যা পায় তা-ই দিয়ে চলতে হয়। আমাদের জীবন যাপন খুব সাদামাটা। তিন-চার মাসের একটা সিজন থাকে। বাকি সাত-আট মাস ঘরে বসে থাকতে হয়। এই সময় কিছু গানের রেকর্ডিং, লাইভ, টেলিভিশন, রেডিওতে কাজ হয়। তাই দিয়ে টুকটাকভাবে চলতে হয়। সংগীত আর জীবনের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করি।’

বর্তমান প্রজন্মের কেউ ঢোলকে পেশা হিসেবে নিক— চান না আকাশ। তিনি মনে করেন, বাদ্যশিল্পী হতে হলে অর্থের মায়া ত্যাগ করতে হবে। কেননা এই পেশার মানুষদের জীবন স্বচ্ছন্দে চলে না। আকাশের কথায়, ‘সংগীত পেশায় যারাই আসবেন তাদের যুদ্ধে করে বাঁচতে হবে। মিউজিক করে আহামরি ভালো থাকবেন বা প্রচুর টাকা হবে তা সম্ভব না। একজন ঢোলবাদক বা যন্ত্রশিল্পীর জীবন ও সংসার ভালোভাবে চলের না। এই জাগতে আসতে হলে টাকার মায়া ছেড়ে সংগীতকে ভালোবেসে আসতে হবে। মিউজিকের জন্য সব ত্যাগ করতে পারে ওরকম লোক আসা উচিত।’
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব উল্লেখ করে আকাশ বলেন, ‘ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা প্রতিভাবান কাউকে খুজে পেলে তার যত্ন করে, লালন করে, সরকার তার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। তারা চিন্তা করে ওই প্রতিভাবে যত্ন করলে আরও ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাপোর্ট পাই না। এখানে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখান বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখানো হবে। তাছাড়া সরকারের কাছে কিছু বলার মতো কেউ আমাদের থাকে না।’

দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ঢোলবাদক হিসেবে কাজ করছেন ফাজিল মিয়া। দেশের বিভিন্ন স্থানে কনসার্ট ও পালা গানের দলের সঙ্গে গেছেন। উপস্থিত দর্শকদের থেকে যথেষ্ট সম্মান পেয়েছেন তিনি। পরিবার নিয়ে মুটামুটি সুখেই আছে ফাজিল মিয়া। তবে হতাশা প্রকাশ করলেন নতুন বাদ্যশিল্পীদে নিয়ে।
তিনি বলেন, ‘নতুনরা না বুঝেই এই পেশায় ঢুকছেন। আমদেরকে সবাই যেভাবে সম্মান করে নতুদের সেভাবে করে না। আমাদের দেশের শিল্পীদের কোনো মূল্যায়ন নেই। আমি অনেক রাজনীতিবিদদের বাসভবনে গিয়ে ঢোল বাজিয়ে গান শুনিয়েছি কিন্তু মূল্যায়ন পাইনি।’
ইএইচ/

