শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৪। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ম-ম করছে নতুন বইয়ের ঘ্রাণে। পছন্দের বই কিনতে ও লেখকের সান্নিধ্য পেতে মেলায় হাজির হচ্ছেন বইপ্রেমীরা। লেখকরাও পাঠকদের সাথে সংযুক্ত হতে নিয়মিত থাকছেন মেলায়।
এদিকে বিনোদন অঙ্গনের তারকা তথা অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পীরাও রয়েছেন লেখক তালিকায়। মেলায় বই কেনার পাশাপাশি তারকা দর্শন পাঠকদের কাছে যেন বাড়তি পাওনা। কেউ কেউ দল বেঁধে যান প্রিয় তারকার বই কিনতে। সম্মিলিত সে উন্মাদনা কখনও বাঁধ ভাঙে। অনেকে ভালোভাবে নেন না বিষয়টি। মনে করেন মানে নয়, খ্যাতির কারণেই বিক্রি হয় তারকাদের বই। ধারণাটি কতটা যৌক্তিক জানতে কথা হয় মেলায় বই এসেছে এমন কয়েকজন তারকার সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
অভিনয়ের পাশাপাশি লেখক হিসেবে খ্যাতি আছে বর্ষীয়ান অভনেতা আবুল হায়াতের। ১৯৯১ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম বই ‘আপ্লুত মরু’। তারপর থেকে লেখক হিসেবে নিয়মিত তিনি। এবারের মেলায় আসছে আবুল হায়াতের বই ‘অপমান’। প্রকাশ করছে প্রিয় বাংলা প্রকাশন। দুই-তিনদিনের মধ্যেই বইটি চলে আসবে বলে জানালেন আবুল হায়াত। খ্যাতি নাকি মানের কারণে তারকাদের বই বিক্রি হয়— জানতে চাওয়া হয় গুণী এ অভিনেতার কাছে।
তারকাদের বই বিক্রিতে খ্যতির প্রভাব পড়ে বলে মানেন নন্দিত এ অভিনেতা। কিন্তু মান না থাকলে সে প্রভাব খুব একটা কাজে দেয় না বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেইলকে আবুল হায়াত বলেন, ‘খ্যাতি বা পরিচিতির একটা প্রভাব থাকে। কৌতূহল থাকে। অনেকে ভাবেন, আবুল হায়াত তো অভিনয় করেন কী ছাইপাশ লিখেছেন একটু পড়ে দেখি। এরকম ভেবেও কিনতে পারেন কেউ। অসম্ভব কিছু না। তারপর যদি পড়ে ভালো লাগে স্বাভাবিকভাবেই সে পরবর্তী সময় কিনবে। বলবে, ওনার লেখা আমার ভালো লেগেছে। কিনে দেখি। যেমন ধরুন, এখন যদি আমি শুনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বই লিখেছেন। তাহলে আমি ঠিকই কিনব বইটি। উনি কী লিখেছেন সেটা জানতে। এটা খুব স্বাভাবিক।’
আরও পড়ুন: বইমেলায় ছবির ‘জলছবি’
এবারের বইমেলায় মেলায় লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ফারজানা ছবি। ‘জলছবি’ নামের একটি বই এসেছে তার। বইটি প্রকাশ করেছে মিজান পাবলিশার্স। ‘জলছবি’ তে ছবি তার সমসাময়িক কিছু জীবনের গল্প বলেছেন। অনুভূতি, মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা তুলে ধরেছেন। সম্পর্কের গল্প বলেছেন। পাঠকেরা তাদের চারপাশের দেখা জীবনগুলোকে ‘জলছবি’ তে খুঁজে পাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি। বইটি নিয়ে অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান এ অভিনেত্রী। তবে তিনি বিশ্বাস করেন না, এই সাড়া তার পরিচিতি বা তারকা খ্যাতির ফসল।
ছবি বলেন, ‘আপনার এই কথাকে যদি আমার পক্ষ থেকে অন্যভাবে বলি তাহলে, তারকা খ্যাতি তৈরি করা কিংবা একজন অভিনয়শিল্পী কিংবা সংগীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলা কিন্তু সৃষ্টিশীলতার একটি অংশ। যে মানুষগুলো সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের কিন্তু জন্মগতভাবে বা ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে একটি সম্পৃক্ততা থাকে। এই সম্পৃক্ততা একজন শিল্পীকে সুন্দরভাবে ভাবতে, অনুভূতির পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে সাহায্য করে। একজন শিল্পী যদি নিজের ভাবনা-চিন্তা গ্রন্থাকারে লেখেন এবং তার লেখা যদি পাঠকের কাছে ভালো লাগে তখনই তা পাঠক গ্রহণ করেন। ওই শিল্পীর গ্রন্থটি সংগ্রহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এখানে আসলে অন্যায় কিছু দেখছি না। যে মানুষ ভালো লেখেন, একটি লেখায় যখন সাহিত্যমান থাকে তখন এমনিতেই সেটি গ্রহণযোগ্য হবে। হন তিনি তারকা বা অন্য যে কেউ।’
আরও পড়ুন: টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের দাবি, বিস্মিত শবনম ফারিয়া
তিনি বলেন, ‘তারকা খ্যাতির কারণেই যে একজন তারকার বই নিয়ে আলোচনা হয় বা হিড়িক পড়ে এই কথাটি ভুল। আর সব তারকা তো লেখার জন্য আগ্রহী হচ্ছেন না। কিছু কিছু তারকা আগ্রহী হচ্ছেন যারা সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন, সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে। কেউ কবিতা লিখছেন, গল্প, উপন্যাস লিখছেন। শুধু খ্যাতির কারণে বই বিক্রি হয় ধারণাটি ঠিক না। একজন সেলিব্রেটি যখন একটি বই লেখেন সেটা নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি বেশি হয়, পাঠকের কৌতূহল থাকে— এটা ঠিক। তার মানে এই না যে, আপনি ভালো না লিখলেও আপনার বই পাঠক পড়বেন। আপনার লেখা যখন ভালো হবে সাহিত্যমান থাকবে তখন তা পাঠককে এমনিতেই টানবে।’
তবে অন্যদের তুলনায় লেখালেখিতে তারকাদের চাপ বেশি থাকে। এরকম মনে করে গুণী অভিনেত্রী ফারজানা ছবি বলেন, ‘আমাদের লেখার প্রতি পাঠকের প্রত্যাশা বেশি। তারা ধরেই নেন একজন তারকা যখন একটি বই লিখবেন তখন সেটা অবশ্যই ভালো মানের হবে। কারণ তারা তাকে ভালোবাসেন, অনুসরণ করেন। আমাদের কাছে পাঠকের প্রত্যাশা বেশি থাকে। সেকারণে আমাদের অনেক সচেতন থাকতে হয়, চাপ নিতে হয়।’
গুণের বিচারে অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা যেন একের ভেতর সব। ছবি আঁকা, লেখালেখি, অভিনয়— সর্বত্র সৌরভ ছড়ান। বইমেলায় নিয়মিত বই আসে তার। এবারও ব্যতিক্রম নয়। মিজান পাবলিশার্স থেকে শিগগিরই ‘কাজের মেয়ে’ নামের একটি বই আসছে ভাবনার।
বই বিক্রিতে খ্যাতির প্রভাবকে ইতিবাচক মনে করে ভাবনা বললেন, ‘যদি কারও খ্যাতির কারণে বই বেশি বিক্রি হয় সেটা তো ভালো। এতে আমি কোনো অসুবিধা দেখছি না। ইতিবাচকভাবেই দেখছি।’
দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড অ্যাশেজের ভোকাল জুনায়েদ ইভানের জনপ্রিয়তা দেখার মতো। যেখানেই যান সেখানেই ভক্তরা ঘিরে ধরেন। লেখক হিসেবে তারও রয়েছে একাধিক বই। ইউ পাবলিকেশন্স থেকে এবার মেলায় এসেছে ইভানের প্রবন্ধমূলক আত্মজীবনী ‘আমার গান ও কিছু কথা’।
মেলার শুরুতেই ইভানের বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এরকম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক ভালো সাড়া পাচ্ছি। সবাই সংগ্রহ করছেন। অনেকে প্রি অর্ডার করছেন।’
খ্যাতির কারণেই কী বিক্রি হয় তারকাদের বই এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কে বই লিখছেন কে লিখছেন না এ নিয়ে আমি অতটা ভাবি না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবন লেখালেখি করেছেন। শেষ বয়সে এসে আবার ছবি এঁকেছেন। ওনার তো ছবি আঁকার কথা না। ওনি কেন ছবি এঁকেছেন? কারও ভেতর যদি প্রতিভা থাকে তিনি যদি আইনজীবী হন তবে কি বই লিখতে পারবে না? যেকোনো মানুষই তার প্রতিভা বিকাশ করার সুযোগ পাবে। সে যদি জনপ্রিয় হয়ে থাকে তাহলে ভালো। আর যদি তার লেখার জ্ঞান না থাকে, কিন্তু সে জনপ্রিয় কেউ তাহলে সেটা ভালো না। যেকোনো ব্যক্তি এই অধিকার রাখে যে সে কি গান গাইবে নাকি বই লিখবে না কী করবে। তিনি যদি তারকা হন তাহলে তারকা খ্যাতির কারণে তো একটা সুবিধা পাবেনই। এটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু মান না থাকলে সে সুবিধা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।’
আরআর