মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ডলার সংকটে বিদেশে পড়ার স্বপ্ন কি ফিকে হয়ে যাবে!

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

ডলার সংকটে বিদেশে পড়ার স্বপ্ন কি ফিকে হয়ে যাবে!
ফাইল ছবি

বৈশ্বিক কারণে দেশের বাজারে গত কয়েক মাস ধরে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। এতে বিদেশে পড়তে ইচ্ছুক ও পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা পড়েছেন সমস্যায়। কিছু ছাত্র সেই সমস্যা নিজেরাই সমাধান করছেন বিকল্প উপায়ে। কিন্তু বাকিরা আছেন অনিশ্চয়তায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার কোটা পূরণে পিছিয়ে পড়বেন। পাশাপাশি অনেকে আগ্রহ হারাবেন বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশে যারা এই মুহূর্তে অবস্থান করছেন এবং পড়াশোনা চালাচ্ছেন তারা বেশি সমস্যায় পড়ছেন না। তবে যারা দেশে আছেন তারা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছেন আজিজুল হাকিম (ছদ্মনাম)। দেশটিতে যাওয়ার আগে তিনি স্টুডেন্ট প্রোফাইল খোলার জন্য বেশ কিছু ব্যাংকে গেছেন। কিন্তু খুলতে পারেননি। অবশেষে সেই অ্যাকাউন্ট খুলতে সক্ষম হলেও এবার বিপত্তি বাধে ডলার নিয়ে। তার যে পরিমাণ ডলার নিয়ে যাওয়া দরকার এর অর্ধেক দিতে চায় ব্যাংকগুলো। তাদের কথা- ডলার সংকট চলছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি অঘোষিত ঘোষণা- ডলারের সদ্ব্যবহার করতে হবে। পরে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের এমডিকে ম্যানেজ করে সেই ডলার সমস্যার সমাধান করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন: ডলার সংকটে বিপাকে বিদেশগামী শিক্ষার্থীরা

আজিজুলের বাবার পরিচিতি আছে বলে তিনি সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন। কিন্তু যার এমন কেউ নেই তারা কী করবে- সেই প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের।

এর বিপরীত গল্পও পাওয়া গেছে। যারা কোনো ব্যাংকেই অ্যাকাউন্ট খুলতে না পেরে অন্যের অ্যাকাউন্ট দিয়ে কাজ সারছেন। সময় ক্ষেপণ না করে প্রোফাইল ছাড়াই কেউ কেউ রওয়ানা হচ্ছেন ঝুঁকি জেনেও। তেমনি একজন বর্তমানে ইতালিতে থাকা নীলজৃত রকি। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আবেদন করেছি, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। এরপর ব্যাংক প্রোফাইল ছাড়াই আবেদন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা পাঠানোর জন্য আমার এক পরিচিত ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়। ওই অ্যাকাউন্টেই ফিক্সড ব্যালেন্স শো করি। ভাই আমার হয়ে জমা দেন এবং আমি পেপারস জমা দিই। আমার জানামতে, এভাবে সবাই আসতে পারে না। এটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে প্রোফাইল করা সম্ভব হয়নি বিধায় এই ঝুঁকিটা নিই। প্রোফাইল ছাড়াই আমি এসেছি ইতালিতে।

রোমানিয়া থাকেন মিরাজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি শতভাগ স্কলারশিপে পড়তে এসেছি। এরপরও প্রোফাইলের প্রয়োজন হয়নি। তবে অ্যাম্বাসিতে একটা যৌথ পরিচিত ভাইয়ের প্রোফাইল দেখিয়েছি।’

সম্প্রতি ইংল্যান্ডে মাস্টার্স করছেন আদিব চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে ডিরেক্ট ডলার আনতে পারছি না প্রয়োজনমতো। এখানে এক বড় ভাই আছেন, তার থেকে ডলার অ্যাকাউন্টে জমা করছি। ভাই আগে দেশে টাকা পাঠাতেন, এখন আর পাঠান না। বাবা দেশে তার বাড়িতে প্রয়োজনীয় টাকা দিচ্ছেন।’

edu2

আদিব চৌধুরীর মতো এখন হাজারও শিক্ষার্থী বিদেশ থেকে বিকল্প উপায়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ মেটাচ্ছেন।

মলডোবায় থাকা শিক্ষার্থী আনন্দ রায় বলেন, ‘এটা একেক দেশে একেক নিয়ম। মলডোবায় স্টুডেন্ট প্রোফাইল ছাড়া শিক্ষার্থী আসতেই পারবে না। এমনকটি যৌথ অ্যাকাউন্ট বা অন্য কারও মাধ্যমে অর্থ দেখানো যাবে না। এখানে আমি প্রথমে এক দেশি ভাইয়ের কাছে টাকা নিই। দেশে বাবা তার পরিবারের অ্যাকাউন্টে জমা দেন। তবে এখন পার্ট টাইম জবের কারণে টাকা লাগছে না।’

আরও পড়ুন: ফোনে ফোনে চলছে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা

নরওয়ের শিক্ষার্থী আদ্রিতা তাবাসসুম বলেন, ‘এখন নরওয়েতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আসার উৎকৃষ্ট সময়। কোনোরকম আইইএলটিএস স্কোর ভালো থাকলেই আসা যাবে। আর এনশিওর করতে হবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চ্যালেন। যা হবে প্রপার চ্যানেলে। আবার অ্যাকাউন্টে দেখানো অর্থ নরওয়েতে এসে খরচও করতে পারবেন। তবে স্টুডেন্ট প্রোফাইল ছাড়া এদেশে আসা সম্ভব না।’

এ বিষয়ে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা তো ছাত্রদের অ্যাকাউন্ট অবশ্যই করাতে চাই, কিন্তু সম্প্রতি বিপত্তিটা বেধেছে ডলার সংকটের কারণে। হিসাব করে করে খরচ করে গ্রাহকদের খুশি রাখতে হচ্ছে। কিন্তু তারা তো খুশি হচ্ছেন না। কারণ চাহিদা মাফিক ডলার পাচ্ছেন না বেশিরভাগ গ্রাহক।

গত এক যুগ ধরে বিদেশে পড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পরামর্শ ও তাদের পাঠানোর কাজ করেন আব্দুল আলিম। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা গত মাসে কয়েকটি প্রাইভেট প্রিমিয়ার ব্যাংকে কাজ করিয়েছে, এখন তারা করছে না। বাধ্য হয়ে অন্য আরকটি ব্যাংকে কাজ করাতে হচ্ছে। প্রিমিয়ার ও এনআরবি ব্যাংকে শিক্ষার্থীরা কাজ সারছে, কিন্তু বাকিরা কোনো সার্ভিসই দিচ্ছে না। এই দুটি ব্যাংক এমন সেবা দেওয়ার নেপথ্যের কারণ হলো- তারা ছাত্রদের পড়তে যাওয়ার জন্য লোন দেয়।’

এ ব্যাপারে সিটি ব্যাংকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী বাইরে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই প্রস্তুতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ডলারের চাহিদা মেটানোর কথা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কিংবা ডলারের সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। তার মধ্যে একটি বিদেশি শিক্ষার্থীদের ফাইল ওপেন না করা। এতে আসলে অনেক ডলার চলে যায়। তবে এখানে বিষয়টি পড়াশোনার, একাডেমিক ক্যারিয়ারের এবং মানবসম্পদ তৈরির ব্যাপার। একজন শিক্ষার্থী যখন বাইরে পড়াশোনা করে কর্মে ঢুকবেন তখন তিনি দেশের জন্য মানবসম্পদ অথবা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তিনি সম্পদ। সেই জায়গা থেকে আমাদের এখন যে ডলার পরিস্থিতি তাতে একেবারে শিক্ষার্থীদের ফাইল ওপেন না করা বা বিষয়টি বন্ধ করে দেওয়া ভালো উদ্যোগ নয় বলে মনে করি।’

আরও পড়ুন: নতুন বছরে আশা দেখাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ

তৌহিদুল হক বলেন, ‘সেক্ষেত্রে বিদেশে পড়তে যেতে ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে সরকার কিছু বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই ব্যবস্থার মধ্যে হতে পারে যার দ্রুত সেমিস্টার শুরু হবে তাকে আগে সুযোগ করে দেওয়া। এদেশের অনেক ব্যাংকের শাখা বিদেশে রয়েছে। যখন কোনো শিক্ষার্থী ডলার সংকটে পড়ছেন, তার এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশে থাকা সেই শাখার সাথে আলাপ-আলোচনা করে ব্যাংকগুলো ডলার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে।’ ‌‌

edu3

ঢাবি অধ্যাপক বলেন, ‘রাষ্ট্র আরেকটা কাজ করতে পারে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করতেই পারে। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে যদি কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তবে শিক্ষার্থীদের মনে বিদেশ যাওয়ার সময় একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। এছাড়া রাষ্ট্র যে সর্বোচ্চ অভিভাবক সেটা নিয়েই বিরূপ ধারণা ও নানা ধরনের নেতিবাচক প্রশ্নের উদয় হয় একজন শিক্ষার্থীর মনে। তার মনের নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার মধ্যে ফেলে দেয়। ‌এই সময় রাষ্ট্রের চিন্তা করে দেখার সময় এসেছে। সরকার শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে তারা যাতে দ্রুত পড়াশোনা জন্য বিদেশে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করবে-এটাই প্রত্যাশা।’

গত দুই যুগ থেকে বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য পাঠান আব্দুল আলিম। রাজধানীর পান্থপথে তিনি একটি কনসালটেন্সি ফার্ম খুলে এই ব্যবসা চালান। তিনি বলেন, ‘ডলার সংকট মোকাবেলায় সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর বিদেশে পড়তে যাবে তার জন্য অ্যাকাউন্ট খুলতে না পারা এবং সময় মতো সেমিস্টারের টাকা পরিশোধ করতে না পারার দরুণ অনেকের এখন হুমকির মুখে। কেউ বিকল্প উপায়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা হাতেগোনা। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার যে কোটা রয়েছে সেটি পূরণ করা কঠিন হবে। ফলে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের ঘাটতি হবে। সেই শূন্যতা অন্য দেশ থেকে পূরণ করবে দেশগুলো। ‌এতে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী নেওয়ার ক্ষেত্রে।’‌

ড্রিমল্যান্ড এডুকেশনের মালিক আব্দুর রউফ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এখন এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশে পড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা যেতে না পারলে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি রেমিট্যান্সের ওপরেও প্রভাব ফেলবে। তারা ডলার ইনডোর্স করতে না পারলে বিদেশ যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।’

এম্পল এডুকেশনের মালিক রোকন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের একটা কোটা থাকে। এই সমস্যার কারণে অনেকে যেতে পারছে না বলে আমাদের কাছে আসছে। আমরা তাদের ডলার ইনডোর্স করিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সব ব্যাংক এই সেবা দিচ্ছে না। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যেতে না পারলে দেশগুলোতে অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাবে। এতে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।’

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর