অন্যান্য বছর নভেম্বর মাসের শুরুতেই প্রায় ১০ কোটি বই ছাপা শেষে পৌঁছে যেত জেলা-উপজেলায়। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। এখনও বিগত বছরগুলোর তুলনায় অর্ধেক বইই ছাপার কাজ শেষ হয়নি। এতে বছরের শুরুর দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
আগামী ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিকের প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হবে নতুন পাঠ্যক্রম। সেই পাঠ্যক্রম চূড়ান্ত করতে বিলম্ব হওয়া, পাণ্ডুলিপি বিলম্বে প্রস্তুতকরণসহ নানা কারণে এই দুই শ্রেণির বই ছাপাকাজের টেন্ডার দেওয়া ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিতে দেরি হওয়ায় পিছিয়ে গেছে ছাপার কাজও।
বিজ্ঞাপন
কাগজ ও পাল্প সংকট, বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ছাপাকাজ বিঘ্ন হওয়া, ছাপাকাজ পাওয়া কয়েক প্রতিষ্ঠান কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোসহ নানা কারণে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঘোষণা দিয়েছেন, এবারও প্রতিবারের মতো বছরের দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাবে।
আরও পড়ুন: নানা জটিলতায় সময়মতো বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা
এদিকে বই ছাপানোর জন্য সরকার যে দর দিয়েছে, তার চেয়ে নিজেরা কম দর দিয়ে কাজ পেয়েছেন মুদ্রণকারীরা। এখন সেই দরেই পুরোদমে চলছে আগামী শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ। তবে কম দরে কাজ পাওয়ায় মান নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা সত্যি হতে চলেছে। কারণ, ইতোমধ্যে ছাপা হওয়া মাধ্যমিক পর্যায়ের তিন কোটির বেশি বইয়ের বেশিরভাগই নিম্নমানের।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্যমতে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক স্তরে নয় কোটি ৪৩ লাখ ৯২ হাজার ১৯টি, ইবতেদায়িতে দুই কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার ১৪৪টি, দাখিল স্তরে চার কোটি এক লাখ ৪৪ হাজার ৮৮টি, মাধ্যমিক স্তরে ১৬ কোটি ৩৭ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৫টি বই ছাপা হবে। এছাড়া বিভিন্ন স্তরের বইসহ সব মিলে মোট ৩৩ কোটি ৯৬ লাখ নয় হাজার ৬৫৭ কপি নতুন বই ছাপানো হবে।
বিজ্ঞাপন
এনসিটিবির একাধিক সূত্র জানায়, প্রাথমিকের প্রাক প্রাথমিক, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই ছাপানোর জন্য দরপত্র মূল্যায়ন করে অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ক্রয়-সংক্রান্ত (পারচেজ) কমিটির কাছে পাঠায়। অভিযোগ রয়েছে, নানা প্রক্রিয়া শেষ করে পারচেজ কমিটির কাছে পাঠাতেই বিলম্ব করেছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ক্রয় কমিটিতে অনুমোদন পাওয়ার পর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে সেটি এখনও মন্ত্রণালয়ে আসেনি। মন্ত্রণালয় থেকে সেটি এনসিটিবিতে আসবে। তারপর নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) জারি করা হবে। নোয়া জারি করার পর ২৮ দিনের মধ্যে চুক্তি হবে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। চুক্তি শেষ হওয়ার পর বই ছাপিয়ে উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর জন্য ৫০ দিন সময় পাবে প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রাথমিকের এসব শ্রেণির বই ছাপানোর জন্য চলতি নভেম্বরের শেষ দিকে চুক্তি করা হলে বই ডেলিভারি দেওয়ার জন্য পুরো জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সময় দিতে হবে। সে হিসেবে ১ জানুয়ারি নতুন বই পাবে না প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন: কাগজ সংকটে যথাসময়ে বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা
আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আগামী ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠদান শুরু হবে। পাঠ্যক্রম চূড়ান্ত করতে বিলম্ব হওয়া, পাণ্ডুলিপি বিলম্বে প্রস্তুতকরণসহ নানান কারণে এই দুই শ্রেণির বই ছাপাকাজের টেন্ডার দিতেই প্রায় এক মাস দেরি হয়েছে। শিগগির এসব বইয়ের ছাপাকাজের জন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে।
ছাপা হয়েছে এমন কয়েকটি বইয়ের মান যাচাই, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি, মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ও মুদ্রণকারীদের সঙ্গে কথা বলে নিম্নমানের বই ছাপার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। মূলত এবার প্রাথমিকের বই প্রতি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা) দুই টাকা ৯০ পয়সা আর মাধ্যমিকের বই প্রতি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা) প্রাক্কলন করা হয় দুই টাকা ৬৮ পয়সা। কিন্তু দুই স্তর মিলিয়ে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ কম দরে কাজ করছেন মুদ্রাকরেরা।
এনসিটিবি বইয়ের মান ঠিক রাখার জন্য দরপত্রে স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করে দেয়। দরপত্রের শর্তানুযায়ী প্রাথমিক স্তর ও ইবতেদায়ির বই ৮০ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা মণ্ড থাকতে হয়।
নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের বই চার রঙা মুদ্রণে ৭০ জিএসএম কাগজে এবং অন্য শ্রেণির বই ৬০ জিএসএম কাগজে ছাপতে হয়, আর বইয়ের কভারে ২৩০ জিএসএমের আর্ট কার্ড (মোটা কাগজ) ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়া ব্যবহৃত কাগজ কতটা মজবুত, তার নির্দেশনাকারী ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ ন্যূনতম ১২ শতাংশ থাকতে হবে।
মান যাচাইয়ে নিযুক্ত ইনডিপেনডেন্ট ইন্সপেকশন সার্ভিস বিডির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, যে বইগুলো ইতোমধ্যে ছাপা হয়েছে, সেসব খুবই নিম্নমানের। তারা যাচাইকালে এ বিষয়ে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করেছেন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ বাতিলও করা হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য ক্ষমতাবলে বেশির ভাগ মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর বেশি কাজ পাওয়া দুটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাতিল করা কাগজ অদল-বদল করে বই ছাপাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বইয়ে কাগজ ব্যবহার করছে না, বাঁধাইও খুবই নিম্নমানের। এতে ছয় মাস যেতে না যেতেই বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
এনসিটিবির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেসব মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবার বেশি পরিমাণে বই ছাপার কাজ পেয়েছে, তারাই মূলত বেশি লাভের আশায় নিম্নমানের বই ছাপাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস, লেটার এন কালার লিমিটেড, বারোতোপা প্রিন্টার্স, আনন্দ প্রিন্টার্স, প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন উল্লেখযোগ্য।
বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া সম্ভব কী না এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, বছরের শুরুতে নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগিতা করলে ডিসেম্বরের মধ্যে বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব।
আরও পড়ুন: একটি করে ইসলামি বই কেনার আহ্বান শায়খ আহমাদুল্লাহর
বইয়ের মান প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এনসিটিবি থেকে ৩৩টি টিম বই ছাপার কাজ মনিটরিং করছে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে মনিটরিং করছে। নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার কিছু অভিযোগ আমরাও পেয়েছি, এগুলোর তদন্ত হচ্ছে। নিম্নমানের বই দেওয়ার চেষ্টা করা হলে কেউই ছাড় পাবে না। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর আগে গত ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সভায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের শুরুতে নতুন বই তুলে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। মুদ্রণ শিল্পের যা যা সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। কাগজের সংকট নিয়ে মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তারা আমাকে কথা দিয়েছেন কাগজ সংকট হবে না।
এসএএস/জেবি