ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই ক্যাম্পাসেই নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা। ডাকসুতে ভিপি, জিএসসহ ২৩টি এবং জাকসুতে শীর্ষ দুই পদসহ ২০টির বেশি আসন পেয়েছেন তারা।
দেশের শীর্ষ এই দুটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রশিবির কখনোই শক্তিশালী কোনো অবস্থানে ছিল না। তারপরও তারা অভূতপূর্ব ফলাফল করেছে। কিছু দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির আগে থেকেই শক্তিশালী। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, চাকসু ও রাকসুতেও শিবির ভালো ফলাফল করবে।
বিজ্ঞাপন
ইসলামী ছাত্রশিবিরের হঠাৎ এই ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উত্তাপ ও নির্বাচনের আগে এক বছরের দীর্ঘ প্রস্তুতি, হলে ও ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক সংযোগ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে। ভোটের এই ফলাফলে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
ডাকসু নির্বাচনের ছয় মাস আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা জানতেন শিবিরের প্যানেল থেকে ভিপি পদে আবু সাদিক কায়েম এবং জিএস পদে এস এম ফরহাদ প্রার্থী হবেন। অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন এত আগে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি। শিবিরের পরিকল্পনা ছিল কেবল জিততেই নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে প্যানেল তৈরি করা। এতে চারজন ছাত্রী এবং চাকমা সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষার্থী রাখার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্যানেলের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে। তাদের প্যানেলে হিজাব পরা এবং হিজাব না পরা দুই ধরনের প্রার্থী রাখা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর যখন আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তখনও শিবির কৌশলগতভাবে নিজেকে গোপন রেখেছিল। রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ না করেও তারা হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছে। কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড, শিক্ষার্থীদের সাহায্য এবং নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই ধারাবাহিকতা ছিল নির্বাচনি প্রস্তুতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আবু সাদিক কায়েমকে জুলাই অভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রতিফলিত হয়েছে। আল-জাজিরার তথ্যচিত্রে তাকে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র সংগঠক হিসেবে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো হালকা প্রচারণার মধ্যেই আটকে ছিল। বিভাজন এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা তাদের ভোটারদের কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে। শিবিরের দীর্ঘদিনের সংগঠন, অর্থায়ন এবং কৌশলপূর্ণ যোগাযোগ তাদের অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রেখেছে। নির্বাচনী প্রচারণা মাত্র ২০ দিনের হলেও এটি কেবল সাময়িক প্রচারণার ফল নয়। শিবিরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ, সক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব এবং সবার কাছে পৌঁছানোর প্রয়াস মিলিত হয়ে জয়ের পথ তৈরি করেছে।
নির্বাচনে শিবিরের সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ নামে পরিচিত ছিল। ২৮টি পদে তাদের প্রার্থীরা ২৩টিতে জয়ী হয়েছেন। কেন্দ্রীয় সংসদে ১৩টি সদস্যপদের মধ্যে ১১টি পদে তারা জয় পেয়েছে। ভিপি পদে আবু সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোটে জয়লাভ করেছেন। জিএস পদে এস এম ফরহাদ ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়েছেন। এজিএস পদে মুহা. মহিউদ্দীন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচনে শিবির সমর্থিত প্রার্থীদের জয় কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সংগঠিত কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থায়ী যোগাযোগেরই ফল। তাদের মতে, ভিপি ও জিএসসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে জয় প্রমাণ করেছে—ক্যাম্পাসে শিবির কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ছাত্ররাজনীতির যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা দক্ষভাবে কাজে লাগিয়েছে তারা।
শিক্ষার্থীরা মনে করেন, নির্বাচনের আগে থেকেই হলে ও ক্যাম্পাসে শিক্ষাবান্ধব কার্যক্রম, সহায়তা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল তৈরির মাধ্যমে আস্থা অর্জন করা হয়েছিল। ফলে ভোটের দিন শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতি আস্থা রেখেছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, এই ফল শুধু প্রচারণার কারণে নয়, বরং দীর্ঘদিনের গোপন কৌশলের প্রতিফলন। অন্যদিকে, অনেকেই একে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শিবিরের প্রকাশ্য এবং গোপন নেটওয়ার্ক এত বিস্তৃত যে, সাধারণ ইস্যু তৈরি করতে পারে। ডাকসুতে তাদের জয় অনুমেয় ছিল। যারা অনুমান করতে পারেননি, তারা চিন্তার গভীরতার স্বল্পতা দেখিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মামুন আল মোস্তফা ঢাকা মেইলকে বলেন, ছাত্রদল বাংলাদেশের প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছিল ২০০৬ সালের শেষ দিক থেকে। ২০০৭ সালের পর থেকে তাদের কার্যক্রম ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ আমলে তারা নীতি-নির্যাতনের শিকার হয়। এ সময়ে সংগঠন প্রায় ভেঙে পড়ে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দীর্ঘদিন ছাত্রদলের কোনো কার্যক্রম ছিল না। সম্প্রতি মাত্র এক-দেড় মাস আগে তারা আবার সক্রিয় হয়েছে। অন্যদিকে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ইসলামপন্থী অন্যান্য ছাত্রসংগঠন ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় থেকেছে। বিএনপি আমলে তারা প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালিয়েছে আর আওয়ামী লীগ আমলে তারা কৌশল পরিবর্তন করে গোপনে সক্রিয় থেকেছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের ভেতরে ঢুকে বিভিন্ন পদ-পদবি ব্যবহার করে নিজেদের নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রেখেছে। ফলে তাদের পরিচিতি, সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনসংযোগ দীর্ঘ সময় ধরে অটুট ছিল।
অধ্যাপক ড. মামুন আল মোস্তফা বলেন, একটি কমিটি যদি কয়েক বছর ধরে কার্যকর থাকে এবং তা যদি কয়েক দশক ধরে চলে, তবে স্বাভাবিকভাবেই তাদের নেটওয়ার্ক ও পরিচিতি অনেক বিস্তৃত হয়। বিপরীতে ছাত্রদল ধারাবাহিকতাহীন অবস্থায় হঠাৎ সক্রিয় হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের অনুপস্থিতির কাজ স্বল্প সময়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এই বিশ্লেষক বলেন, হল-রাজনীতিতেও এই পার্থক্য স্পষ্ট। সম্প্রতি ছাত্রদল যাদের দিয়ে কমিটি করেছে, তাদের অনেকেই আগে হলে ছিল না, তারা কার্যত ক্যাম্পাসের বাইরেই ছিল। আর ছাত্রশিবির সেই পুরনো নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আবারও সক্রিয় হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতাই এখানে তাদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ভোটের প্রতিযোগিতায় ছাত্রদল সাংগঠনিক ও সামাজিক ভিত্তিতে পিছিয়ে পড়েছে। তাদের মেয়াদ মাত্র মাসখানেক, অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো দেড় দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে সক্রিয় থেকেছে। ধারাবাহিক কার্যক্রম, কৌশলগত অবস্থান এবং সামাজিক সম্পর্কই তাদের এগিয়ে দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, তারা সম্ভবত দীর্ঘ সময় ধরে নির্দিষ্ট জায়গাগুলোকে টার্গেট করে প্রস্তুতি নিয়েছে। সেই প্রস্তুতির সময়কাল অনেক দীর্ঘ, আর সেই প্রস্তুতির ফলই আজকে তারা ঘরে তুলেছে। এখানে একটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার—ছাত্রদল দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত থাকলেও অন্য সংগঠনগুলো কোনো না কোনোভাবে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা গোপনে ভিন্ন ব্যানারের আড়ালে কাজ করেছে, সরাসরি ক্যাম্পাস ট্যাগ ব্যবহার করেনি। এটিই তাদের জন্য একটি বড় সুবিধা হয়েছে।
আরও পড়ুন
ডাকসু-জাকসুতে কোথাও নেই ছাত্রদল
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ছাত্রশিবির যেটা করেছে ছাত্রলীগ কিংবা অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের ব্যানারের ভেতর ঢুকে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। ফলে তাদের ধারাবাহিক প্রস্তুতি অনেক দিন আগে থেকেই চলছিল। একই সঙ্গে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে নানা নেতিবাচক প্রচারণা—যেমন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বা জুলাই আন্দোলনে ভেঙে পড়া—তাদের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো নিজেদের কৌশল স্পষ্টভাবে ঠিক করেছে—কোথায় প্রচারণা চালাতে হবে, কখন কোন ন্যারেটিভ কাজে লাগাতে হবে, কীভাবে নির্বাচনী কৌশল গ্রহণ করতে হবে—এসব তারা সঠিকভাবে বুঝেছে এবং কাজে লাগিয়েছে।
অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, রাজনীতির মাঠে যারা থাকে, প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই তাদের দখলেই যায়। বিএনপি বা ছাত্রদল দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে ছিল, ফলে ক্যাম্পাসে সক্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বীরাই নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছে। বাস্তবিকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, এটি হয়ত বিতর্কিত মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতায় যারা মাঠে ছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের কার্যক্রম টিকিয়ে রেখেছে, তারাই শেষ পর্যন্ত সুবিধা নিয়েছে।
এএইচ/জেবি

