শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পলিটেকনিকে ঝুলছে তালা, আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন!

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
প্রকাশিত: ০৪ মে ২০২৫, ০৭:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

politecnic
বেশির ভাগ পলিটেকনিকে ঝুলছে তালা। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফার আন্দোলনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। গত ছয় দিন ধরে দেশের বেশির ভাগ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রধান গেটে ঝুলছে তালা। ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কমিটি করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই কমিটি কাজও করছে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় দফায় আন্দোলনের পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে বলে জানা গেছে। জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলনে নামানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। পলিটেকনিক শিক্ষকদের ইন্ধনেই এই আন্দোলন চলছে বলেও জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে সঠিক পথে হাঁটছে না। তারা ভুল পথে যাচ্ছে। এজন্য সরকারের আশ্বাস সত্ত্বেও তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। অবিলম্বে কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের দাবিও জানান তারা।


বিজ্ঞাপন


এর আগে গত ২২ এপ্রিল বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের ছয় দফা বাস্তবায়নে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। যাদের তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্যও বলা হয়। কমিটির অন্যতম সদস্য ও ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের সদস্য সচিব প্রকৌশলী কাজী সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা দাবিগুলো নিয়ে কাজ করছি। দুটো সভা করেছি। আগামীতেও সভা হবে। তাদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা চলছে।’

আন্দোলনকারীদের সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ এপ্রিল থেকে সারাদেশের সব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শাটডাউন কর্মসূচি পালন করছেন তারা তারা। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন।

এর আগে গত ২২ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেন কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সেদিন রাতে আন্দোলন সাময়িক স্থগিত রাখার ঘোষণাও দেন তারা। কিন্তু পরদিন ২৩ এপ্রিল তারা আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা প্রত্যাহার করে ফের কর্মসূচি দেওয়ার কথা জানান। এরপর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন তারা। এই দ্বিতীয় দফা আন্দোলন চলমান হওয়ার মূলে ডিপ্লোমা শিক্ষকরা রয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা যায়৷


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

উপাচার্য ছাড়াই চলছে সরকারি-বেসরকারি ৪১ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম

২০২১ সালের তৎকালীন সচিব আমিনুল ইসলাম খান রাতারাতি নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে নতুনভাবে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন। এর আগে কারিগরি থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের শিক্ষার্থীরা এই পদে নিয়োগ পেতেন। যার নীতিমালা পরিবর্তন করে জেনারেল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেন সচিব। এই ক্রাফট ইন্সট্রাক্টররা পদোন্নতির জন্য হাইকোর্টে একটি রিট করেন, যার রায় গত ১৮ মার্চ তাদের পক্ষে যায়। ওই দিন রাতে তেজগাঁও সাত রাস্তার মোড়ে শিক্ষার্থীরা প্রথম আন্দোলন শুরু করেন। ১৬ মার্চ থেকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এদিন তেজগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা অবরোধ করে ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা।

Poli3

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর বা দক্ষ প্রশিক্ষক পদটি কারিগরি শিক্ষার অর্গানোগ্রাম, প্যাটার্ন, বাংলাদেশ সরকারের গেজেট, মন্ত্রণালয়ের আদেশ, বদলির আদেশ, প্রশিক্ষণ আদেশ অনুযায়ী শিক্ষক পদ। দেখা গেছে, কারিগরিতে যারা শ্রেণি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই নির্দিষ্ট মেয়াদ চাকরি করার পর ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পদোন্নতি পাচ্ছেন। কিন্তু সবার পদোন্নতি থাকলেও  ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদধারীদের কোনো পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়নি। অন্যদের ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা পাস করে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর ১০ম গ্রেডে নিয়োগ পেয়ে পর্যায়ক্রমে চতুর্থ গ্রেডে অধ্যক্ষ পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ থাকলেও ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শিক্ষকদের বড় একটা অংশ ক্রাফট ইন্সট্রাকক্টরদের পদোন্নতি চান না। যার ফলে তারা আদালতের রায় উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করছেন।

নতুন করে আন্দোলনের নেপথ্যে…

শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর মূলত শিক্ষকদের ইন্ধনেই তারা আবার আন্দোলন শুরু করেন। এছাড়া পলিটেকনিকের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আন্দোলনে নিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরুতেই বাংলাদেশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শিক্ষকরা তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে দেশের কোনো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করেননি।

আরও পড়ুন

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেপথ্যে কারা?

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক পলিটেকনিকের পঞ্চম সেমিস্টারের একজন শিক্ষার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের শুরু থেকেই শিক্ষকরা আমাদের পাশে ছিলেন। এখনো আছেন। আন্দোলনে যাওয়ার জন্য সিনিয়ররা বিভিন্নভাবে বুঝিয়েছেন এবং আন্দোলনে না যেতে চাইলে ক্যাম্পাসে সমস্যা হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।’

আন্দোলনে ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিষয় অস্বীকার করে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অন্যতম প্রতিনিধি মাশফিক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এমন কিছুই করা হয়নি। আমরা নিজেদের দাবি আদায়ে সবাই ঐকবদ্ধভাবে আন্দোলন করছি।’

Poli4

আন্দোলনে ইন্ধন থাকার বিষয়ে কথা বলতে অসম্মতি জানান বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি মফিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের শুরুর দাবি এবং এখনকার দাবির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। তবে আমরা সরকারি চাকরি করি, এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আমরা পদোন্নতি পাই না। কেউ বঞ্চিত হলেও কি আদালতে যাওয়া যাবে না? কেউ আদালতে গেলে তাকে ছাত্র লেলিয়ে হেনস্থা করা কি বিবেকবান মানুষের কাজ? যারা আদালতে গিয়েছেন তাদেরসহ এই পদের সবাইকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

মেট্রো স্টেশনে হকারদের উৎপাত, মাসে ১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি

তিনি আরও বলেন, ‘মূলত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ আমাদের পদোন্নতি চান না। তাদের কারণেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে।’

ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিনিধি মাশফিক ইসলাম বলেন, ‘৬ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা সভার করার পরও কোনো বিবৃতি দিচ্ছে না। আমরা চেয়েছিলাম প্রতিটি সভার পর আমাদের অফিসিয়ালভাবে আপডেট জানানো হবে৷ কিন্তু সেটা হয়নি। তাই আমরা মনে করছি মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি সঠিক পথে নেই। ফলে আমরা নিজেদের দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি।’

বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি মফিজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা আগে বিবৃতি দিয়েছি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আর আগের দাবিগুলোর মধ্যে নেই, তাদের দাবির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এর বাইরে আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’

এএসএল/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর