গত কয়েক দিন ধরে ছয় দফা দাবিতে সারাদেশে টানা আন্দোলন করছেন দেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা। সবশেষ রোববার (২০ এপ্রিল) রাজধানীসহ সারাদেশে সমাবেশ করে দাবি আদায়ে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের আওতাভুক্ত শিক্ষার্থীদের জোট কারিগরি ছাত্র আন্দোলন। এই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। এই অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অচলাবস্থা এবং জনদুর্ভোগের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চ আদালতে ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের পদোন্নতির রিটের রায় প্রকাশের পর থেকে জোরদার হয়েছে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন। এর নেপথ্যে রয়েছে পলিটেকনিকের শিক্ষক এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সদের একটি বড় অংশ। ছাত্রদের সামনে রেখে মূলত তারাই আন্দোলন চাঙ্গা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রদের ভুল বুঝিয়ে এই আন্দোলনে নামানো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক আলোচনার পরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অনড় রয়েছে। তাদের দাবিগুলোর ব্যাপারে সরকার আন্তরিক রয়েছে এবং এই সমস্যার সমাধানে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের পদোন্নতি হলে ডিপ্লোমার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হবে। ফলে বিষয়টি তারা চান না। এছাড়া ২০২১ সালের নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন চান তারা। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বাকি দাবিগুলো খুবই যৌক্তিক হিসেবে দ্রুত মেনে নেওয়ার আহ্বান তাদের।

এদিকে গত ১৮ এপ্রিলের পর থেকে ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টররা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে ঢুকতে পারছেন না। তাদের দাবি, দীর্ঘদিন চাকরির পর যদি কেউ পদোন্নতি না পায় তাহলে আদালতে যাওয়া অপরাধের কিছু নয়। আর আদালত সবকিছু বিবেচনা করে ন্যায্য পক্ষেই রায় দিয়েছে। যদিও সেই রায় ইতোমধ্যে হাইকোর্টে স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আন্দোলনের সূত্রপাত যেভাবে
২০২১ সালে সচিব আমিনুল ইসলাম খান দায়িত্বে থাকাকালে ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টর নিয়োগের নীতিমালায় পরিবর্তন আনেন। আগে কারিগরি থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের শিক্ষার্থীরা এই পদে নিয়োগ পেতেন। যার নীতিমালা পরিবর্তন করে জেনারেল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেন সাবেক প্রভাবশালী সচিব। ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টররা তখন পদোন্নতির জন্য হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন, যার রায় গত ১৬ মার্চ তাদের পক্ষে যায়। মূলত এর পর থেকেই আন্দোলনে নামেন কারিগরি শিক্ষার্থীরা। রায়ের দিনই তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তার মোড়ে শিক্ষার্থীরা প্রথম আন্দোলন শুরু করেন। যেটা বর্তমানে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
গত ১৬ মার্চ থেকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এদিন তেজগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা অবরোধ করে ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন করেন তারা। পরবর্তী সময়ে রেলওয়ের ব্লকেড, কাফনের কাপড় পরে মিছিল, সারাদেশে মশাল মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। সবশেষ ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর বা দক্ষ প্রশিক্ষক পদটি কারিগরি শিক্ষার অর্গানোগ্রাম, প্যাটার্ন, বাংলাদেশ সরকারের গেজেট, মন্ত্রণালয়ের আদেশ, বদলির আদেশ, প্রশিক্ষণ আদেশ অনুযায়ী শিক্ষক পদ। দেখা গেছে, কারিগরিতে যারা শ্রেণি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই নির্দিষ্ট মেয়াদ চাকরি করার পর ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পদোন্নতি পাচ্ছেন। কিন্তু সবার পদোন্নতি থাকলেও ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদধারীদের কোনো পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়নি। অন্যদের ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা পাস করে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর দশম গ্রেডে নিয়োগ পেয়ে পর্যায়ক্রমে চতুর্থ গ্রেডে অধ্যক্ষ পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ থাকলেও ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি।
‘ভুল বুঝিয়ে’ আন্দোলন, জনদুর্ভোগ চরমে
জানা যায়, দীর্ঘ অমীমাংসিত ব্যাপারটি আদালতের রায়ে সমাধান হয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের অনেকটা ভুল বুঝিয়ে রাজপথে নামিয়ে দেয় এই রায়ের বিরুদ্ধে থাকা পলিটেকনিক শিক্ষক ও ইঞ্জিনিয়ারদের একটি বড় অংশ। ফলে সারাদেশে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে মানুষকে জিম্মি করে আদালতের রায় বাতিল করতে চাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

গত ১০ এপ্রিল থেকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি শুরু হয়েছে। ১৭ এপ্রিল ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র ও ২০ এপ্রিল গণিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমন পাবলিক পরীক্ষার মধ্যে প্রতিদিন দেশব্যাপী কারিগরি ছাত্ররা নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এসব কর্মসূচির ভোগান্তি নেতিবাচকভাবে দেখছেন সাধারণ মানুষেরা।
এসএসসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবক ও ঢাকার একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আজিজুর রহমান বলেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তেজগাঁও এলাকায় প্রচুর জ্যাম ছিল। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয়েছে। দেশের এত বড় পরীক্ষার দিনে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে ফেলে আরেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ না দেখে এমন আন্দোলন কাম্য নয়।
এ বিষয়ে কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি জোবায়ের পাটোয়ারী বলেন, আমাদের আন্দোলন এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে থেকে চলমান রয়েছে। আর পরীক্ষা দিনগুলোতে শিক্ষার্থীরা হলে যাওয়ার পর আমরা কর্মসূচি দিয়েছি, যাতে তাদের ভোগান্তি না হয়।
নেপথ্যে পলিটেকনিক শিক্ষক ও ইঞ্জিনিয়াররা!
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমর্থনে সভা করে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি এবং ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি)।

শিক্ষক সমিতির বিবৃতিতে বলা হয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরাধীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (সপ) ও ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (টি.আর.) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতায় সাধারণ শিক্ষার গ্রাজুয়েটদের বাদ দিয়ে পূর্বের ন্যায় এইচএসসি (ভোক) ও এসএসসি (ভোক) অন্তর্ভুক্তকরণ কারিগরি শিক্ষা ও দেশের জাতীয় স্বার্থে নিয়োগ বিধি সংশোধনপূর্বক পদার্থ, রসায়নে ডিগ্রিধারীদের বাদ দিয়ে পূর্বের ন্যায় এইচএসসি (ভোক) ও এসএসসি (ভোক) উত্তীর্ণ ভোকেশনাল গ্রাজুয়েটদের ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (সপ) ও ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (টি.আর.) পদে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট এই সভা হতে জোর দাবি জানানো হয়।
ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের বিবৃতিতে বলা হয়, কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের ন্যায়সঙ্গত ছয় দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই সভা থেকে সকল পোশাজীবী সংগঠন, আইডিইবি'র জেলা নেতৃবৃন্দকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি মফিজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলতে চাই না। তবে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ভালো না থাকলে পড়তে আসবে কেন?

তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের সদস্য সচিব প্রকৌশলী কাজী সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক নই। তবে আন্দোলনের পাশে আছি। কারণ আন্দোলনের নামে দেশে সহিংসতা করে লাভ নেই। তাই জুনিয়রদের আন্দোলন সফল করতে আমরা স্বাভাবিক সহযোগিতা করছি।
জনদুর্ভোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সব সময় বলে আসছি যাতে জনদুর্ভোগ না হয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের নয়। পুরো কারিগরি শিক্ষাকে রিপ্রেজেন্ট করছে এই আন্দোলন। এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও সাবেকরা সমর্থন দিয়েছেন। ২০২১ সালের অবৈধ নিয়োগ বাতিল করে আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এছাড়া অন্যান্য সব যৌক্তিক দাবি দ্রুত মেনে নিতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আমরা পদোন্নতি পাই না। কেউ বঞ্চিত হলেও কি আদালতে যাওয়া যাবে না? আর আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, যাদের যোগ্যতা আছে কেবল তারাই পদোন্নতি পাবেন। এখানে অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তবু আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রকৌশলী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ছয় দাবির মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ রয়েছে শিক্ষক ও সাবেকদের। তারাই মূলত আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামিয়েছে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর যৌক্তিকতা বিশ্লেষণের জন্য আইডিইবি ও আইইবির সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন দেখে আমরা দ্রুতই সমাধান করব।’
সচিব বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলছি। কিছু বিষয় আছে, তারা না জেনে দাবি করছেন। যেটা সত্য নয়; যেমন—আদালতের রায়ে কোথাও ৩০ শতাংশ কোটা ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের জন্য রাখা হয়নি। আর কিছু বিষয় আছে যেটা এ মন্ত্রণালয়ের (শিক্ষা) কারিগরি বিভাগ একা পূরণ করতে পারবে না। এর সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের যোগসূত্র রয়েছে। ফলে আমাদের দিক থেকে শিক্ষার্থীদের কোনো দাবির প্রতি দ্বিমত নেই।’
এএসএল/জেবি

