রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

কোনো নিয়মই মানেন না শিক্ষার ‘ম্যানেজ খালেক’!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২৪, ১০:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

কোনো নিয়মই মানেন না শিক্ষার ‘ম্যানেজ খালেক’!
ছবি: সংগৃহীত
    • মন্ত্রণালয়-মাউশির চিঠিও পাত্তা দেন না ঢাকা অঞ্চলের ডিডি
    • এমপিভুক্ত করার সব কাজ একাই সারেন ডিডি
    • মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করার সুযোগ নেই: মাউশির কর্মকর্তা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওর কাজ সহজীকরণের সুবিধার্থে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০২২ সালে কারা কারা এমপিও যাচাই-বাছাই কমিটিতে থাকবেন সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নির্দেশনায় নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক অংশের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অঞ্চলের অধীন জেলা/বিভাগীয় শহরের সরকারি একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক (মাউশি মনোনীত) এবং এমপিওভুক্ত একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে রাখতে বলা হয়েছে। ঢাকায় গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের এই কমিটিতে থাকার কথা। কিন্তু ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক এস. এম আব্দুল খালেক মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা না মেনে অনেকটা এককভাবেই দিনের পর দিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও করাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।


বিজ্ঞাপন


অভিযোগ আছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্বে আসা আব্দুল খালেক সব মিলিয়ে সহস্রাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রে একক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। যা শিক্ষা প্রশাসনে অনেকটা ওপেন-সিক্রেট। তবে খালেক একাই নন, এই কাজে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির অসাধু কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা-কর্মচারী তাকে সহযোগিতা করছেন বলে জানা গেছে। এসব কর্মকর্তাকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে ম্যানেজ করে চলার কারণে শিক্ষা প্রশাসনে তিনি ‘ম্যানেজ খালেক’ হিসেবে পরিচিত। 

মাউশির ঢাকা অঞ্চলের এমপিও কমিটির সদস্য হিসেবে না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খোদ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন তালুকদার। চলতি বছরের নভেম্বরে তিনি পিআরএলে যাবেন।

ঢাকা মেইলকে আলমগীর হোসেন তালুকদার বলেন, ‘আমাকে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের এমপিওসংক্রান্ত কোনো কাজে কখনো ডাকা হয়নি। আমি যে কমিটির সদস্য তাও জানি না। কখনো কেউ জানায়নি। আপনার কাছ থেকে শুনলাম।’


বিজ্ঞাপন


তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক স্বাক্ষরিত বেসরকারি মাধ্যমিক-৩ শাখা থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেই পরিপত্রে এমপিওর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইন আবেদন যাচাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কমিটিকে দেওয়া হয়।

পরবর্তী সময়ে ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে এমপিও কমিটিতে মাউশির মহাপরিচালকের প্রতিনিধিসহ যারা থাকবেন তাদের তালিকা তৈরি করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক অংশের জন্য যে অঞ্চল পর্যায়ের কমিটি, সেখানে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উপপরিচালক, অঞ্চলের অধীন জেলা/বিভাগীয় শহরের সরকারি একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক (মাউশি মনোনীত) এবং এমপিওভুক্ত একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে রাখতে বলা হয়েছে। মাউশির সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-২) এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরী।

ঢাকার আঞ্চলিক উপপরিচালকের এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরীর ভাষ্য, এমপিওর কাজ সহজ করার সুবিধার্থে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে কারা কারা থাকবেন তা মাউশি থেকে বলে দেওয়া হয়েছে। উপপরিচালক এটা নির্ধারণ করবেন। এই কমিটি এমপিওভুক্তির আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট শাখায় ফরোয়ার্ড করে দেবে। কেউ একা সেটি করতে পারবেন না। করলে তিনি সরকারি নির্দেশনা অমান্য করবেন।

নিজের কাজের পক্ষে সাফাই গাইতে মাউশির ২২ ডিসেম্বরের চিঠির বিপরীতে ৮ ডিসেম্বরের একটি পুরাতন চিঠি প্রতিবেদককে পাঠান এস.এম আব্দুল খালেক। যদিও পরবর্তী সময়ে এমপিও যাচাই-বাছাই কমিটিতে কারা থাকবেন মাউশি তা সুস্পষ্ট করে চিঠি দেওয়ায় আগের চিঠির কার্যকারিতা হারিয়েছে।

টাকা লেনদেন হয় হাসপাতালে!

অভিযোগ আছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করতে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন করতে হয় খালেকের সঙ্গে। কখনো কখনো সেই অংক লাখ টাকা পর্যন্ত যায়। মাউশির ঢাকা অঞ্চলের অফিসে এমপিওসংক্রান্ত কাজের বিষয় তার সঙ্গে কথা বলার নির্দেশনা দিয়ে একটি নোটিশও টানানো আছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এমপিওসংক্রান্ত কাজে অফিসে গেলেও উপপরিচালক আব্দুল খালেক প্রায় সময় বাইরে দেখা করেন। এজন্য ধানমন্ডির একাধিক হাসপাতালকে বেছে নেন এই কর্মকর্তা। যেখানে এমপিওভুক্ত হতে আগ্রহীদের থেকে ঘুষ নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

হাসপাতালে টাকা লেনদেন করার বিষয়ে আব্দুল খালেক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি ধানমন্ডির তিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাই। ওখানে টাকা নেওয়ার জন্য আমাকে কে রুম ঠিক করে রাখবে আপনিই বলেন।’

আরও পড়ুন

শিক্ষা কর্মকর্তার ‘ঘুষের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে’ শিক্ষকদের আকুতি

কোচিং-প্রাইভেট পড়ানোর দ্বন্দ্বে অস্থির ভিকারুননিসা!

অনিয়মের অন্তহীন অভিযোগ, ফাঁসছেন শিক্ষক নেতা!

অন্যদিকে আর্থিক লেনদেনে রাজি না হওয়ায় ঢাকা অঞ্চলের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দিনের পর দিন ঘুরতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মাউশির ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের অধীনে ১১টি জেলা রয়েছে। সেগুলো হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ী।

রাজধানীর ফরিদাবাদের বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখানকার একাধিক শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে অনেক টাকা খরচ করেছে। অঞ্চলে নাকি টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না।’

অন্যদিকে উত্তরার একটি এমপিওভুক্ত স্কুলের একজন শিক্ষিকা অভিযোগ করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার কাছে সরাসরি টাকা চাওয়া হয়েছে। অঞ্চলে টাকা দিতে পারিনি বলে এক বছর ধরে ঘুরছি। এখনো এমপিও হয়নি। ঘুষ দিয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার ইচ্ছা নেই।’

অভিযোগ নিয়ে যা বললেন উপপরিচালক

নিজের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই দাবি করে আব্দুল খালেক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যারা টাকা দিয়েছে, যাদের টাকার জন্য এমপিও হচ্ছে না তাদের প্রমাণ দিতে বলেন। এমপিওভুক্তিতে টাকা লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই।’

উত্তরার শিক্ষকের অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘ওই শিক্ষকের নিয়োগ যথাযথ হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী তিনি ১১ গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা, তিনি চান দশম গ্রেডে। কীভাবে সম্ভব? এখন টাকার কথা বললে কী বলার আছে।’

এমপিও কমিটিতে সদস্য করার বিষয়ে মাউশির চিঠি অমান্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক নয়, আমরা জেলা কমিটি করেছি। আমার আওতাধীন ১১ জেলায় কমিটি করা আছে।’

যদিও মাউশির উপপরিচালক (মাধ্যমিক) আবদুল আজিজ বলছেন ভিন্ন কথা। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করার সুযোগ নেই। আঞ্চলিক কমিটির তিনজন সদস্য ছাড়া একা এমপিওভুক্তির কাজ সম্পন্ন করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ করে থাকলে তা আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।’

বিইউ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর