প্রতিষ্ঠার ১০২ বছরে এসেও মৌলিক অনেক সমস্যা থেকে এখনও বের হতে পারেনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এসব সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবাসন সংকট, গণরুম-গেস্টরুম কালচার, লাইব্রেরিতে আসন স্বল্পতা, ক্লাসরুম সংকট, বিশ্বমানের গবেষণা না হওয়া, পর্যাপ্ত ট্রান্সপোর্ট সুবিধে না থাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব মৌলিক সমস্যার পেছনে বিচ্ছিন্ন অনেক কারণ থাকলেও এর অন্যতম মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতার তুলনায় অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী। ১৯২১ সালে মাত্র ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ হাজারেরও বেশি। যুগের চাহিদা অনুযায়ী বিভাগ-ইনিস্টিটিউট ও ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও বাড়েনি এর আয়তন। উল্টো লোকমুখে চাউর থাকা ঢাবির ৬০০ একরের মাত্র ৩৭৫ একর জমি দখলে রাখতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ। আবার এর মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জমি লিজ নিয়ে দখল করে আছে ব্রিটিশ কাউন্সিল, পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ও পুলিশ ফাঁড়ির মতো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এভাবেই সক্ষমতার বিপরীতে প্রতিবছর অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়ে যুগের পর যুগ এ সমস্যা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় আসন সংখ্যা কমিয়ে আনা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। এর আগে গত বছরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ ইনিস্টিটিউট থেকে স্নাতক পর্যায়ে ১ হাজারেরও অধিক আসন কমিয়ে আনা হয়। বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন পুনর্নির্ধারণের এমন সিদ্ধান্তকে ভালো দৃষ্টিতেই দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্রিয়াধীন মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য তিন ধাপে নতুন ১৭টি একাডেমিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে লাইব্রেরির জন্য বর্ধিতাংশ ভবনর প্রস্তাবনাও রয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য তিন ধাপে আনা নতুন হলও বর্ধিতাংশ ভবন করা হবে। ছেলেদের জন্য তিন ধাপে ১৭টা নতুন বর্ধিতাংশ ভবনসহ হল তৈরি করা হবে।
ক্লাসরুম সংকট
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশি ক্লাসরুম সংকট কলা ভবনে। কলা অনুষদের এমন অনেক বিভাগ রয়েছে যেখানে ক্লাস করার জন্য পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। যে রুমগুলো রয়েছে সেগুলোতেও বিভাগের সব শিক্ষার্থীর জায়গা হয় না। ফলে প্রায় সব বিভাগে ক্লাস সংকুলান কাটাতে শিক্ষার্থীদের ভাগ ভাগ করে ক্লাস নেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নঈম হাসান বলেন, আমাদের ক্লাসে ১০০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ধারণক্ষমতা রয়েছে ৭০ জনের। বাকি শিক্ষার্থীরা আলাদা চেয়ার এনে, কখনও শিক্ষকদের ডেস্কের পাশে বসে বসে ক্লাস করে।
একই চিত্র আরবি বিভাগেও। মাত্র দুটি ক্লাসরুমে বিভাগের ৬-৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকভাবে ক্লাস করতে হয়। মাঝেমাঝে অন্য বিভাগের রুমে ক্লাস করতে যেতে হয় বলে জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষার্থী ইসমাইল হোসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতানুল আরেফিন বলেন, আমাদের কোনো নির্ধারিত ক্লাসরুম নেই। একেকদিন একেক কক্ষে ক্লাস করতে হয়। আবার ব্যাচের সকল শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত ক্লাস হলে অন্য ক্লাসরুমে যেতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কয়েকটি বিভাগে দেখা যায়, প্রায় ২৫০ এর মতো শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে একটি কক্ষে ক্লাস করতে হয়। ফলে উচ্চশিক্ষায় ছাত্রের সঙ্গে শিক্ষকের যে যোগাযোগ বা সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন তা হয়ে উঠে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা দুইশর অধিক শিক্ষার্থী একসঙ্গে ক্লাস করে থাকি। প্রায়ই শিক্ষকরা এত সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে একসঙ্গে ক্লাস করার বিষয়ে সমালোচনা করে থাকেন।
আবাসন সংকট
শিক্ষার্থীর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই পর্যাপ্ত হল। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে প্রথম বর্ষের কোনো শিক্ষার্থী হলে বৈধ সিট পায় না। ফলে ক্ষমতাশীল ছাত্ররাজনীতির ছত্রছায়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব শিক্ষার্থীরা আশ্রয় হয় গণরুমগুলোতে। যেখানে আশ্রয় দেওয়া ও ম্যানার শেখানোর নাম করে চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা কমানো হলে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে শিক্ষার্থীদের অত্যাচার কারে থাকে তার পরিমাণ কিছুটা হলেও কমবে।
যদিও এর ভিন্ন মতও রয়েছে। শিক্ষক ও ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম গেস্টরুম সংস্কৃতি বদ্ধ শুধু মাত্র প্রশাসনের সদিচ্ছার উপরেই নির্ভর করে। শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতারা যতদিন না চিন্তা করবে শিক্ষার্থীদের তাদরে স্বার্থে ব্যবহার না করবে ততদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন পুনর্নিধারণের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, গত ১০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নতুন ট্রেন্ড দেখতে পাচ্ছি যে অনেক নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে। যেগুলো খুব বেশি সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই না করেই করা হয়েছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এখন প্রায় সব জেলাতেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। এখন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় এসেছে তাদের পরীক্ষাটাকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার। এমন শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা যারা জ্ঞানের ওই জায়গাটাতে যেতে চাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমার সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ৩ বছর আগেও আড়াইশ আসন ছিল। এখন ওখান থেকে কমে এসে ১৭০ জনে এসেছে এবং আমরা মনে করি এ সংখ্যা আরও কমা উচিত। কারণ, এই সংখ্যক শিক্ষার্থীকে একটা ক্লাসরুমে পড়ানো না শিক্ষকদের জন্য, না ছাত্রদের জন্য যথোপযুক্ত। আমার অবকাঠামো আছে ১০০ ছাত্র পড়ানোর, সেখানে আমার ১০০ জন ছাত্রই নেওয়া উচিত। কখনোই আড়াইশ ছাত্র নেওয়া উচিত নয়। কারণ, তাদেরকে আবাসনের নিশ্চয়তা দিতে পারি না। তাদেরকে পড়ালেখার জন্য লাইব্রেরির একটা আসনের নিশ্চয়তা দিতে পারি না। কেন তাদের জীবনটাকে কখনও কখনও বিপন্ন করে দেব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, বাস্তবতা হলো আমাদের ক্লাসগুলোতে যখন সব ছাত্ররা উপস্থিত থাকে তখন সবাই বসতে দিতে পারি না। আমাদের যে সক্ষমতা তার থেকেও বেশি শিক্ষার্থীদেরকে আমাদের পড়াতে হয়। বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কয়েকটি বিভাগের বাস্তবতা হচ্ছে তাদের দুইশ-আড়াইশ এরও বেশি ছাত্র। এটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে না। আগে এ কাজগুলো করা হয়েছে অনেককিছু ভাবনা চিন্তা না করেই। উচ্চশিক্ষা আর গণশিক্ষার মাঝে তো পার্থক্য রয়েছে। সেটা বিবেচনা করে যদি আমার একটা ক্লাসে দুইশ ছাত্র থাকে তাহলে উচ্চশিক্ষার যে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার প্রতিফলন থাকে না। তাতেই শিক্ষার্থী সংখ্যা যৌক্তিকই হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, উচ্চশিক্ষার কথা বলে সবাইকে আমি ক্লাসে নিয়ে আসলাম, কিন্তু দিন শেষে সে তো প্রতারণার শিকার হয় যখন সে ক্লাসে এসে বসার যায়গা পায় না। স্বাভাবিকভাবেই একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়া মাত্রই হলে তার সিটের ব্যবস্থা থাকা উচিত। ফলে সে রাজনীতির ছত্রছায়ায় গণরুমগুলোতে থাকে। পরে সে ক্যাডারে পরিণত হয়। কত স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। শেষপর্যন্ত মাস্তানি চাঁদাবাজিতে জড়ায়। এমনকি নিজের ক্লাসমেটকেও মারতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এমন পরিবেশের কারণ তো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার এমন বৈশিষ্ট্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকক্ষেত্রেই নেই। সেক্ষেত্রে আমার সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে সে বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করাটাই উচিত।
আসন কমানোর সঙ্গে গণরুম-গেস্টরুম কমার বিষয়ে তিনি বলেন, কালচারটা কিছুটা কমে আসবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমি তাদেরকে ক্লাসরুমেই বসতে দিতে পারি না। আমি আমার ছাত্রদের পড়াচ্ছি কিন্তু সালাম দিলে বলতে পারব না কোন ব্যাচের ছাত্র সে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়া উচিত। সংখ্যাটা এমন পর্যায়ে থাকবে যেন প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীকে আমি টেক কেয়ার করতে পারি।
বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ধারণক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, মানসম্মত শিক্ষার কথা যদি আমরা বলি তাহলে আসন কমিয়ে আনা জরুরি। আমাদের গবেষণায় শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ানো উচিত। যখন আমরা এ কাজগুলো করতে পারব তখন বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়বে, বিদেশের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়বে। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে একাডেমির সম্পর্ক তত বাড়বে।
তিনি বলেন, কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোতে আন্ডারগ্রাজুয়েটে তেমন প্রয়োজন নেই, কিন্তু গবেষণায় রয়েছে। এগুলো প্রথমে মাস্টার্স হিসেবে চালু হয়েছে। পরে আন্ডারগ্রাজুয়েট খোলা হয়েছে। এগুলোতে এখন বন্ধ করা সম্ভব না।
প্রতিনিধি/এমএইচটি

