শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শিল্প খাত পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা, কমবে রফতানি আয়

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৮ আগস্ট ২০২২, ০৯:৪৪ এএম

শেয়ার করুন:

শিল্প খাত পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা, কমবে রফতানি আয়

দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ছে প্রায় সব সেক্টরে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে শিল্প খাতে। সম্প্রতি গ্যাস রেশনিং ও লোডশেডিংয়ের কারণে এমনিতেই উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল শিল্প কারখানাগুলোতে। তার ওপর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এই খাতের জন্য বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এটা শিল্প খাতে বড়ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। ব্যাহত হতে পারে উৎপাদন, কমতে পারে রফতানি আয়।

করোনা পরিস্থিতির বড় ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সংকটে পড়ে দেশের জ্বালানি খাত। খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এতে সারাদেশেই দেখা দেয় বিদ্যুৎ সংকট। গত ১৮ জুলাই রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক এক সমন্বয় সভায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় করতে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ১৯ জুলাই থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, দিনে এক-দুই ঘণ্টা লোডশেডিং, ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ, সপ্তাহে এক দিন বন্ধ থাকবে পেট্রোল পাম্প, রাত আটটার পর শপিং মল বন্ধসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা।

সরকারের সিদ্ধান্তের পর জনসাধারণের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় অনেক শিল্প কারখানাকে। অনেক শিল্প কারখানা আছে যেগুলোর মেশিন ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। না হলে সমস্যা হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে সেগুলোতে সমস্যা হচ্ছে। এর মধ্যে লোডশেডিং কমাতে এলাকাভিত্তিক কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন: জনগণের ভোগান্তি বাড়াবে, সরকারের জন্যও নেতিবাচক

সম্প্রতি বাংলাদেশ সিরামিকস ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আজিজুল হাকিম এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘সিরামিক শিল্পের মেশিনারিজগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। এখানে ৩৬৫ দিন গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাগে। কিন্তু গ্যাসের সংকটের কারণে প্রতিদিনই আমাদেরকে সুইচ অন অফ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এই খাত রুগ্ন শিল্প হয়ে যাবে।’

গ্যাস সংকটে যখন শিল্পের নাজেহাল অবস্থা তখন নতুন করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি শঙ্কা ডেকে আনে শিল্পখাতে। করতে হচ্ছে অনেক হিসাব-নিকাশ। এবিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএম) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। অপারেট খরচ বাড়বে। একদিকে আমরা বলতাম ৬৭ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্টের টার্গেট দিচ্ছি। অন্যদিকে যদি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে তবে টার্গেটে তো আমরা পৌঁছতে পারব না। বিশ্ববাজারে যেহেতু তেলের দাম কমছে, আমরা কেন আর কিছুদিন অপেক্ষা করলাম না। বিপিসি পাঁচ বছরে লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। তাদের আরও লাভের কেন প্রয়োজন! আমরা আশা করবো সরকার শিল্পের স্বার্থে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করবে।’


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: জ্বালানি সংকটের সমাধান কোন পথে?

জ্বালানি তেলের এই দাম জনসাধারণের পাশাপাশি কৃষি ও শিল্পখাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মূলত ডিজেলের ব্যবহার যে খাতগুলোতে বেশি হয়, পরিবহন ও কৃষি, শিল্প খাতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে। ডিজেল ব্যবহার করে যেসব কারখানায় উৎপাদন করা হয়, সেখানেও এর একটা প্রভাব পড়বে। তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি  মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেবে।’

এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পোশাক রফতানিকারক ও মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দেশে পরিবহন ভাড়া বাড়বে, ট্রাক ভাড়া বাড়বে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি। এসবের সাথে শ্রমিকদের বেতনও বাড়াতে হবে। লস থেকে বেঁচে থাকতে হলে অনেক কারখানা বন্ধ করা ছাড়া কেনো উপায় থাকবে না। এই মুহূর্তে কারখানায় গ্যাস সংকট, সরকার নির্দেশিত লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ থাকে না পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। এ কারণে দিনে ছয় ঘণ্টার জন্য জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ায় বেশি জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের হাতে প্রচুর অর্ডার রয়েছে। বড় অংকের লস দিয়ে এসব অর্ডারের পণ্য উৎপাদন করতে হবে।’

rrr

ফারুক হাসান বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি টিকে আছে ফরেন এক্সচেঞ্জের ওপর। গত বছর যে রফতানি আয় হয়েছে তার ৮২ শতাংশই এসেছে পোশাক খাতের মাধ্যমে। এ কারণে এখনও মুদ্রাস্ফীতি আমাদের সেভাবে বাড়েনি। কিন্তু নতুন করে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিশ্ববাজারে আমাদের টিকে থাকা কষ্টকর হবে। দেশের স্বার্থে এই মুহূর্তে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও তেলের দাম না বাড়ানো উচিত ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এ বছর যে পরিমাণ রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেই টার্গেট অর্জন করা যাবে না। পুরনো অর্ডারগুলোতেই অনেক লস হবে। নতুন করে প্রোডাকশনে যাওয়া যাবে না। ফলে রফতানিতে পিছিয়ে যাব।’

এদিকে, নিরুপায় হয়েই জ্বালানি তেলে সমন্বয় করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও  খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে হচ্ছে। জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় আমজনতার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে। যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করেনি। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা হবে।’

আরও পড়ুন: বেতনের অর্ধেক যায় বাসা ভাড়ায়, সংসার চালানো দায়

গেল ৫ জুলাই (শুক্রবার) জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম একলাফে লিটারে ৩৪ টাকা করে বাড়ানো হয়। নতুন করে ডিজেল ও কেরোসিন এখন ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ১১৪ টাকা করে। অন্যদিকে অকটেনে প্রতি লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৪৬ টাকা। এখন প্রতি লিটার অকটেন ১৩৫ এবং পেট্রোল ৪৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা লিটার। এই হিসাবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ আর অকটেন-পেট্রোলে বেড়েছে ৫১ শতাংশ।

টিএই/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর