ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত নীলক্ষেত শুধু বই বিক্রির জায়গা নয়, বরং ইতিহাস, স্মৃতি আর জ্ঞানের এক বিস্তৃত ভাণ্ডার। একসময় এখানে ছিলো নীলকুঠি- নীল চাষের কার্যালয়। সেই ঔপনিবেশিক ইতিহাস পেরিয়ে জায়গাটি আজ রূপ নিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বই বাজারে। শত শত দোকানজুড়ে প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থী ভিড় জমায়।
নীলক্ষেতের দোকানগুলোতে বই বিক্রি মানেই শুধু নতুন কাগজের গন্ধ নয়। অনেক সময় এখানে এসে পৌঁছায় পুরনো, সেকেন্ড হ্যান্ড বই। কোনো পাঠক হয়তো আর প্রয়োজন নেই ভেবে বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার কখনো পরিবারে কেউ জানেই না, এই পুরনো বইয়ের পাতায় লুকিয়ে আছে তাদের বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদির হাতের লেখা নোট, পরীক্ষার প্রস্তুতির কাগজ কিংবা চিরকুট। এক শিক্ষার্থীর কাছে সেটা কেবল দরদাম করে কেনা বই, কিন্তু বিক্রেতা পরিবারের অজান্তেই চলে যায় একগুচ্ছ স্মৃতি।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
অনেক বইয়ের ভেতরে পাওয়া যায় হলুদ হয়ে যাওয়া বুকমার্ক, হাতে লেখা কবিতা, কিংবা প্রিয়জনের দেয়া উপহারের সই। এগুলো পাঠকের কাছে অব্যবহার্য হলেও, কারও জীবনের গল্প বহন করে আনে। তাই নীলক্ষেত যেন এক অদৃশ্য সংগ্রহশালা যেখানে শুধু জ্ঞান নয়, সময় আর আবেগও কেনাবেচা হয়।
এ কারণেই নীলক্ষেত কেবল শিক্ষার্থীদের ভরসা নয়, বরং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্মৃতি বহন করার নীরব সাক্ষী। এখানে প্রতিটি বই-ই একেকটি গল্প, আর প্রতিটি দোকান যেন একেকটি স্মৃতির ভাণ্ডার।
ইতিহাস
নীলক্ষেত নামটির শেকড় ব্রিটিশ আমলে। এই এলাকায় ছিল "নীলকুঠি" যেখানে নীলচাষ হতো এবং চাষিদের নানা কার্যক্রম চলত। সেখান থেকেই জায়গার নামকরণ হয় নীলক্ষেত। পাকিস্তান আমলে ঢাকার নগরায়ণ বাড়তে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এখানে দোকানপাট গড়ে ওঠে। ষাটের দশকের দিকে শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে কিছু বইয়ের দোকান চালু হয়। আশির দশকের পর দোকানের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে। নব্বইয়ের দশকে এসে নীলক্ষেত পুরোপুরি একটি বইয়ের বাজারে রূপ নেয়।
তখন থেকেই একে ঢাকার শিক্ষার্থীদের প্রাণকেন্দ্র বলা হয়। শুধু নতুন বই নয়, ফটোকপি ও সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের জন্যও নীলক্ষেত অনন্য হয়ে ওঠে। আজকের দিনে এসে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বইপাড়া, যেখানে দেশের প্রায় সব প্রকাশনার বই মেলে।
বইয়ের বৈচিত্র্য
নীলক্ষেতে গড়ে উঠেছে কয়েকশ’ দোকান। এখানে পাওয়া যায়- বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই, স্কুল-কলেজের সহায়ক বই, চাকরির প্রস্তুতির বই, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বই, সাহিত্য, ইতিহাস, গবেষণা ও রেফারেন্স বই, বিরল ও সংগ্রহযোগ্য পুরনো বই।
এছাড়া এখানে প্রকাশিত বিদেশি বইয়ের অনুবাদ, থিসিস বা গবেষণার সহায়ক বইও পাওয়া যায়। অনেক দোকানই সরাসরি ফটোকপির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে বই সরবরাহ করে। ফলে সীমিত বাজেটের শিক্ষার্থীরা এই বাজারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বই ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, নীলক্ষেত থেকে প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার বই বিক্রি হয়। মৌসুমভেদে এ সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ভর্তি পরীক্ষার সময়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সেশনের শুরুতে বা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার মৌসুমে এখানে উপচেপড়া ভিড় থাকে।
নীলক্ষেত শুধু ঢাকার শিক্ষার্থীদের নয়, বরং সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকায় এলে অবশ্যই নীলক্ষেত ঘুরে যান। অনেকেই একসাথে পুরো সেমিস্টারের বই কিনে নিয়ে যান। ফলে নীলক্ষেতকে দেশের "শিক্ষার্থীদের সর্ববৃহৎ বই বাজার" বলাই যায়।
স্মৃতির বেচাকেনা
নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুকলেই বোঝা যায়, এখানে শুধু বই নয়, বিক্রি হয় সময়, অনুভূতি আর স্মৃতিও। অনেক বইয়ের ভেতরে থাকে পুরনো চিঠি, পরীক্ষার খাতা, কোনো শিক্ষকের লেখা মন্তব্য কিংবা ছাত্রজীবনের টুকরো ডায়েরি। কারও অজান্তেই এই স্মৃতিগুলো চলে আসে নতুন ক্রেতার হাতে। অনেকেই গল্প করেন পুরনো বই কিনে খুলে দেখেছেন ভেতরে দাগ টানা জায়গা, হয়তো কোনো শিক্ষার্থী রাত জেগে পড়াশোনা করেছে। কেউ পেয়েছেন শুভেচ্ছা কার্ড, যেখানে লেখা “তোমার সাফল্যের জন্য শুভকামনা” যা হয়তো কোনো বন্ধু বা প্রিয়জন লিখেছিলো বহু বছর আগে। এমনকি কারও কারও সংগ্রহে এসেছে এমন বই, যেখানে প্রথম পাতায় লেখা আছে উপহারের তারিখ, নাম আর ভালোবাসার স্বাক্ষর। এসব স্মৃতি নতুন ক্রেতার কাছে অমূল্য হয়ে ওঠে, কারণ তারা অনুভব করেন একটি বই শুধু কাগজের বাঁধাই নয়, বরং সময়ের সাক্ষ্য বহন করে। এভাবেই নীলক্ষেত বইপাড়া হয়ে উঠেছে প্রজন্মের স্মৃতি আর আবেগের নীরব বাজার, যেখানে প্রতিটি পাতা শুধু জ্ঞান নয়, মানুষের জীবনকাহিনীও বলে।
সকল শিক্ষার্থীদের বিচরণ
মোরশেদ রকিব নামের এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জানালেন, “আমি উত্তরা থাকি। সেখান থেকে নীলক্ষেতে আসতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। তবুও আমি প্রায়ই এখানে আসি, কারণ এখানে সব ধরনের বই একসাথে পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই থেকে শুরু করে সহায়ক বই, এমনকি রেফারেন্স বইও সহজে মেলে। অনেক সময় আমাদের এলাকায় এগুলো পাওয়া যায় না বা দাম বেশি চাওয়া হয়। নীলক্ষেতে এসে একসাথে সব বই কিনে নিতে পারি।”
মেহেদী হাসান নামের এক কলেজ ছাত্র বলেন, “আমি নীলক্ষেতের সবচেয়ে বড় সুবিধা দেখি দামের মধ্যে। একই বই অন্য জায়গায় খুঁজলে দাম অনেক বেশি পড়ে। কিন্তু এখানে তুলনামূলকভাবে সস্তায় বই পাওয়া যায়। বিশেষ করে সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকানগুলো আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ। আমি গত সেমিস্টারে সব বই কিনেছিলাম অর্ধেক দামে। এছাড়া এখানে দরাদরির সুযোগ আছে, তাই সামর্থ্যের মধ্যে কেনা যায়। অনেক দোকানেই ফটোকপি বই পাওয়া যায়, যা টাকার সাশ্রয়ে সহায়তা করে। পড়াশোনার জন্য যখন অনেকগুলো বই কিনতে হয়, তখন নীলক্ষেত ছাড়া বিকল্প ভাবাই যায় না। আমার মতো সীমিত বাজেটের শিক্ষার্থীরা এই কারণেই সবচেয়ে বেশি নীলক্ষেতমুখী হয়।”
গোলাম রব্বানী নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমার পড়ার বিষয় ইঞ্জিনিয়ারিং। নীলক্ষেতেই পাই কোর্স বই, প্রশ্ন ব্যাংক, এমনকি গবেষণার রেফারেন্স বইও। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এখানে মেডিকেল, আইন, সাহিত্য সব বিষয়ের বই মেলে। ফলে এক জায়গায় সবার চাহিদা মেটানো যায়। এটা আসলে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বইয়ের বাজার।”
জায়েদ হাসান নামের এক ছাত্র জানালেন, “নীলক্ষেত শুধু বই কেনার জায়গা নয়, এটা শিক্ষার্থীদের আড্ডারও জায়গা। বন্ধুদের নিয়ে বই দেখতে আসি, ঘুরে ঘুরে দোকান ঘাটি, মাঝে চায়ের দোকানে বসি সব মিলিয়ে একটা প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি হয়। শিক্ষাজীবনের স্মৃতিতে নীলক্ষেতের এই অভিজ্ঞতা অনেক বড় জায়গা দখল করে।”
খুলনা থেকে আসা এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমি ঢাকায় ভর্তি কোচিং করতে এসেছি। নীলক্ষেতের নাম আগে থেকেই শুনেছি। এখানে এসে বুঝলাম সত্যিই সারা দেশের শিক্ষার্থীরা কেন এখানে আসে। আমি একসাথে ভর্তি পরীক্ষার সব বই কিনতে পেরেছি, যা খুলনায় পাওয়া যেত না। এটা শুধু ঢাকার নয়, দেশের সব শিক্ষার্থীর বইয়ের বাজার।”
নীলক্ষেতের পুরনো বই বিক্রেতা আলমগীর হোসেন বলেন, “আমি ৩০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। শুরুতে দোকান ছিল হাতে গোনা কয়েকটা। এখন কয়েকশ’ দোকান। আগে আমরা মূলত ফটোকপি বই বিক্রি করতাম, এখন প্রকাশনার আসল বইও পাওয়া যায়। তবে এখনও সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।”
আরেক ব্যবসায়ী জানান, “প্রতিদিন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী আসে। ভর্তি মৌসুমে তো হাঁটার জায়গা থাকে না। তখন বিক্রি অনেক গুণ বেড়ে যায়।”
নীলক্ষেত কেবল অর্থনৈতিক লেনদেনের জায়গা নয়, এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। এখানে শিক্ষার্থীরা শুধু বই কিনতেই আসে না, বরং জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ও করে। অনেকেই বলেন, “ঢাকায় পড়াশোনা করলে নীলক্ষেত না গেলে শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।”
ডিজিটাল যুগে বই পড়ার অভ্যাস বদলাচ্ছে। ই-বুক ও অনলাইন স্টোর বাড়লেও নীলক্ষেতের আকর্ষণ এখনো অটুট। তবে বই বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতাদের ভিড় আগের মতো থাকলেও মুদ্রিত বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা আছে। তারা চান, সরকার বই ব্যবসায়ীদের আরও সহযোগিতা করুক, বাজারের আধুনিকায়ন হোক।
নীলক্ষেত বইপাড়া শুধু ঢাকার নয়, গোটা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এক অপরিহার্য কেন্দ্র। এটি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থী যে বাজারে আসে, সেটিই প্রমাণ করে বই এখনো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নীলক্ষেত তাই শুধু একটি বাজার নয়, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞানবাহকের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ক.ম/
