বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

‘হেডাম ন থাগিলি ইটভাটা চলের কেনে’

চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশিত: ০১ এপ্রিল ২০২২, ০১:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img
চট্টগ্রামের ইটভাটায় অবাধে পুড়ছে কাঠ। ছবি: ঢাকা মেইল

চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ৩২০টি অবৈধ ইটভাটা চলছে কয়েক দশক ধরে। বনের কাঠ পুড়িয়ে উঁচু চিমনি দিয়ে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে নির্বিচারে। নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে পাহাড়ি মাটি ও ফসলি ভূমির। এতে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটলেও তেমন কোনো তৎপরতা নেই পরিবেশ অধিদফতরের। অথচ এসব ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট আদেশ রয়েছে। এই অবস্থায় জনমনে প্রশ্ন, হাইকোর্টের চেয়েও ক্ষমতাধর চট্টগ্রামের অবৈধ ইটভাটার মালিকরা? তাদের এই শক্তির উৎস কোথায়?

এমন প্রশ্নের উত্তর শোনা যায় স্বয়ং ইটভাটা মালিকদের মুখে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার এমএবি ইটভাটার মালিক শিহাব উদ্দিনের দম্ভোক্তি- ‘হেডাম ন থাগিলি চলের কেনে’ (অর্থাৎ ক্ষমতা না থাকলে চলছে কীভাবে)। 


বিজ্ঞাপন


স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, সরকারদলীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়া, প্রকট চাহিদা, অধিক মুনাফা ও কাঁচামালের সহজলভ্যতায় চট্টগ্রামে যত্রতত্র গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ইটভাটা। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। প্রশাসনের নামমাত্র অভিযান ইটভাটার সাময়িক উৎপাদন থামাতে পারলেও মিলছে না দীর্ঘমেয়াদী সুফল।

উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে ইটভাটার আশ্রয়দাতা হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইটভাটা উচ্ছেদে স্থানীয় প্রশাসনের কৌশলগত অসহযোগিতাও রয়েছে। এতে অসহায়ত্বে ভুগছে বলে দাবি পরিবেশ অধিদফতরের।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের পরিচালক মুফিদুল আলম এ বিষয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। বরাদ্দ স্বল্পতা ও জনবল সংকট রয়েছে। তবুও জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে ইটভাটা উচ্ছেদে আমরা বদ্ধপরিকর।’

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় অবৈধ ইটভাটা রয়েছে ৩২০টি। ১৪ উপজেলার মধ্যে একটি ইটভাটা রয়েছে পটিয়া উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে সাতকানিয়া উপজেলায়। এই উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা ৬৮টি। 


বিজ্ঞাপন


এছাড়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৫০টি, ফটিকছড়ি ও লোহাগাড়া উপজেলায় ৩৩টি করে ৬৬টি, রাউজান উপজেলায় ৩২টি, হাটহাজারী উপজেলায় ৩১টি, চন্দনাইশে ২৮টি, মিরসরাইয়ে ১৩টি, কর্ণফুলী উপজেলায় ১০টি, সন্দ্বীপে ছয়টি, বাঁশখালীতে পাঁচটি, সীতাকুন্ডে চারটি, বোয়ালখালীতে চারটি, আনোয়ারায় দুটি ইটভাটা রয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেগুলো গড়ে তোলা হয়েছে সংরক্ষিত বন ও ফসলি জমিতে। এর মূল কারণ বনের কাঠ, পাহাড়ি ও কৃষি জমির মাটির সহজলভ্যতা।  

অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হতে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না। ৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না।

কিন্তু এসব ইটভাটার মালিক সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর, উপজেলা থেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি-সেক্রেটারি, বিএনপি ও জামায়াত নেতা হওয়ায় কোনো আইন-এমনকি হাইকোর্টের আদেশকেও পাত্তা দিচ্ছেন না। কারণ এদের পেছনে বটগাছের মতো শক্তি যোগাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি-মন্ত্রীরা। 

তবে পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থাভাব ও জনবল সংকটেই গতি পাচ্ছে না অবৈধ ইটভাটা বন্ধের কার্যক্রম। হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও গত এক মাসে আটটি ইটভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সবকটি অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিতে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

অধিদফতরের তথ্যমতে, ৩২০টি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করতে গত বছরের ১২ অক্টোবর তিন কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ চেয়ে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, একটি ইটভাটা উচ্ছেদে খরচ হবে ৭৫ হাজার টাকা। একই অভিযান জেলা প্রশাসন পরিচালনা করলে খরচ পড়বে এক লাখ টাকা। উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে এস্কেভেটর, পে-লোডার ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়। পরিবেশ অধিদফতরের এসব যান-যন্ত্রপাতি নেই। ভাড়া করে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। দূরত্ব থাকায় এক দিনে দুইটির বেশি ইটভাটা উচ্ছেদ করা যায় না। কিন্তু এখনও আসেনি কোনো বরাদ্দ। তাই বিদ্যমান বাজেটে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।

এছাড়া পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো ইটভাটা থেকে আদায়কৃত জরিমানার অর্থ দিয়ে বনায়ন, চারা বিতরণ, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণসহ নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হলে মানুষ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতো। একই সাথে পরিবেশের ওপর আরোপিত ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হতো। একই সাথে মামলা পরিচালনার জন্য নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল গঠনও জরুরি বলে মনে করছেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, নতুন বছরের শুরুতে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে নামার ঘোষণা দিয়েছিল পরিবেশে অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়। জেলা প্রশাসনও সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। দুই সংস্থার যৌথ অভিয়ানে গত এক মাসে আটটি ইটভাটা উচ্ছেদ করা হয়। বাকিগুলোও উচ্ছেদ করা হবে।

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন