বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

মৃত্যুর সংবাদ শুনলেই ঘোড়া নিয়ে ছুটে যান মনু মিয়া

এস এম রায়হান
প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

মৃত্যুর সংবাদ শুনলেই ঘোড়া নিয়ে ছুটে যান মনু মিয়া

কারও মৃত্যুর সংবাদ কানে এলেই খোন্তা, কোদাল, ছুরি, করাত, দা, ছেনিসহ বিভিন্ন সহায়ক যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যান কবরস্থানে। পরম যত্ন আর অপার ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ আশ্রয়স্থল ‘কবর’। মানুষের শেষ বিদায়ের একান্ত সঙ্গী হয়ে সাদা কাপড় পরানো থেকে শুরু করে আতর-গোলাপ মাখিয়ে পাশে থাকেন কবরে মাটি দেওয়া অবধি। হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় শেষ বিদায়ের এই পরম সঙ্গীর নাম মনু মিয়া।

৭০ বছর বয়সী এই মনু মিয়া দীর্ঘ ৫২ বছর কাটিয়েছেন অন্যের কবর খনন করতে করতে। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ও বকশিস ছাড়াই একজন মানুষকে বিদায় জানিয়েছেন পরম মমতায়।


বিজ্ঞাপন


শেষ বিদায়ের সঙ্গী মনু মিয়ার জন্ম কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। বাবা আবদুল হেকিম মিয়া এবং মা সারবানুর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মনু মিয়া তৃতীয়।

Monu

মনু মিয়ার বয়স যখন ১৮ তখন তার মমতাময়ী মা মারা যান। মায়ের স্নেহ বঞ্চিত এই তরুণ যখন দেখেন তার মায়ের জন্য এলাকাবাসী ও তার বাবা-ভাই কবর তৈরি করছেন। তখন তিনিও তাদের সঙ্গে কবর তৈরিতে সহযোগিতা করেন। সেই থেকে তার যাত্রা। এরপর কারও মৃত্যুর সংবাদ শুনলে তিনি স্থানীয় গোরখোদকদের সঙ্গে কবর খনন করতে বেরিয়ে পড়েন।

প্রথম দিনের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মনু মিয়া বলেন, সদ্য টগবগে তরুণ হিসেবে আমার হেসে-খেলে সময় পার করার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য আমাকে আমার মায়ের আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত করল। ব্যাকুল হৃদয় মায়ের কবরের একমুঠো মাটি দিয়ে সেদিনের মতো ঘরে ফিরি। কিন্তু প্রায়ই আমি আমার মায়ের কবর জিয়ারত করে কবরের উপর হাত বুলিয়ে কান্নাকাটি করতাম৷ মায়ের কবরস্থানে নিয়মিত যাওয়া আসা থেকেই একদিন একজনের মৃত্যুর সংবাদ আসে। স্থানীয় গোরখোদকদের সঙ্গে ওই ব্যক্তির কবর খনন করতে যাই।


বিজ্ঞাপন


মনু মিয়া বলেন, প্রথম দিকে তিনি পরিচিতজন ও নিকটাত্মীয়-স্বজনের কবর খননের কাজে অংশ নিতেন। এ থেকে তিমি ক্রমেই দক্ষ হয়ে উঠেন। এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এক সময় এ কাজটিকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে নেন। এরপর তিনি প্রায় ৫২টি বছর নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন কবর খননের কাজে। এই ৫২টি বছরে বনানী কবরস্থানসহ দেশের বিভিন্নস্থানে তিনি খনন করেছেন ৩৫০০টির অধিক কবর।

তিনি আরও বলেন, একজন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে তাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিতে পারার মতো আনন্দ তার কাছে আর কোনোটিই নেই। দুনিয়ার মোহ-সম্পদ কোনোটিই তাকে টানে না।

Monu

তিনি জানান, মৃত্যুর সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছেন কবর খুঁড়তে। নিজের খরচায় দা, খন্তা, কোদাল কিনেছেন একজন মানুষের শেষ বিদায়ের সঙ্গী হতে। এমনকি তার বাবার রেখে যাওয়া ধানী জমি বিক্রি করে একটি ঘোড়া কিনেছেন তিনি। এর ফলে দূরের কোনো মৃত্যুর সংবাদ শুনলে খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছান যায়। তবে শহরে কোথাও গেলে তিনি ঘোড়া বাড়িতে রেখে যান।

মনু মিয়ার স্ত্রী রহিমা বেগম জানান, তাদের কোনো সন্তান না থাকায় বাজার-সদাই করার লোক পাওয়া যেত না। তাই প্রথম দিকে তিনি স্বামীর এসব কাজে বাধ সাধতেন। পরে যেহেতু তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। তখন থেকে স্বামী মনু মিয়াকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। স্বামীর মতোই পাড়া-প্রতিবেশী কোনো মুসলিম মহিলা মারা গেলে তাকে গোসল করিয়ে সাজিয়ে দেন তিনি। এছাড়াও বিনা পারিশ্রমিকে স্থানীয় ছোট ছোট মুসলিম শিশুদের সকাল বেলায় কোরআন শিক্ষা দেন।

আ. রশিদ মিয়া নামে স্থানীয় একজনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, মনু মিয়ার এই মহৎ কাজের কথা গ্রাম ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও মনু মিয়া একজন মানুষের শেষ বিদায়ের সঙ্গী হচ্ছেন এটিই মনু মিয়ার পরম প্রাপ্তি। এলাকাবাসী হিসেবে মনু মিয়াকে নিয়ে আমরাও গর্ববোধ করি।

মনু মিয়ার ভাতিজা নিকলু মিয়া বলেন, চাচা কারও মৃত্যুর সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আর ঘরে বসে থাকেন না। যত দ্রুত সম্ভব সেখানে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যদি রাতে মৃত্যুর সংবাদ শুনেন তবে সেই রাতে তার ভালো ঘুম হয় না। ফজরের আযান শোনার সঙ্গে সঙ্গে নামাজ পড়ে কবর খননের সহায়ক যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়িতে ফিরে গোসল সেরে কত নম্বর কবর খনন করেছেন তা ডায়েরিতে লেখার জন্য যিনি লিখতে পারেন এমন মানুষ খোঁজেন। কাউকে পেলে ডায়েরিতে লিখিয়ে এরপর তিনি ঘরে ফিরেন।

নিকলু মিয়া আরও বলেন, তিনি চাচার সঙ্গে প্রায়ই কবর খনন করতে যান। একজন মানুষের শেষ দিবসের ঘরটি সাজিয়ে দিতে পারায় তিনিও খুশি হন।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর