রোববার, ৫ মে, ২০২৪, ঢাকা

বাগেরহাটের ঐতিহ্য সেমাই পিঠার সঙ্গে হাঁসের মাংস

মো. শহিদুল ইসলাম
প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০২২, ১১:৫৩ এএম

শেয়ার করুন:

বাগেরহাটের ঐতিহ্য সেমাই পিঠার সঙ্গে হাঁসের মাংস

শীত এলেই গ্রামবাংলায় শুরু হয় নবান্ন উৎসব, তৈরি হয় নানা রকম বাহারি পিঠা। অঞ্চলভেদে পিঠার রয়েছে বিচিত্র নাম ও ভিন্ন স্বাদের ঐতিহ্য। বাগেরহাট অঞ্চলের তেমন একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা হলো ‘সেমাই পিঠা’। বাগেরহাটের স্থানীয়দের কাছে এটি মূলত ‘শিয়েই পিঠা’, শেয়াই পিঠা’ বা ‘শিয়াই পিঠা’ নামেই পরিচিত। 

বছরের যেকোনও সময়ই বিশেষ করে বাড়িতে মেহমান এলে এই পিঠা বানানো হয়। একটা সময় ছিল যখন এ অঞ্চলের মানুষ মেহমান আপ্যায়নে খাবারের অন্যতম প্রধান পদ হিসেবে রাখা হতো এই পিঠা। এখনো মেহমান এলে বিভিন্ন বাড়িতে এই পিঠা বানানো হয়। নতুন জামাইকে আপ্যায়নসহ যেকোনও অনুষ্ঠানে বা বিশেষ দিনগুলোতে এ অঞ্চলের মানুষ ভাতের বিকল্প হিসেবে দুপুরে ও রাতের খাবারে শেয়াই পিঠা খেয়ে থাকেন। শীতের শুরুতে বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে শেয়াই পিঠার উৎসবও হয়ে থাকে।


বিজ্ঞাপন


সেমাই পিঠা দেখতে কিছুটা নুডলসের মতো। এই পিঠা বানাতে হয় বিশেষ ব্যবস্থাপনায়— কাঠ দিয়ে তৈরি বিশেষ ঢেকিকল বা পিতলের তৈরি মেশিনের সাহায্যে। পিঠা খেতে হয় অবশ্য কিছুটা ভাতের মতোই— মাংস দিয়ে। এসব এলাকার মানুষ চুইঝাল দিয়ে রান্না হাঁস, মুরগী বা গরুর মাংস দিয়ে সেমাই পিঠা খেতে বেশি পছন্দ করেন। তবে হাঁসের মাংস দিয়ে সেমাই পিঠার স্বাদ সবচেয়ে বেশি ভাল— এবং এটাই বেশি জনপ্রিয়। আর যদি হয় চুইঝাল দিয়ে রান্না চায়না হাঁস বা রাজহাঁসের মাংস তাহলে তো কথাই নাই।

যুগ যুগ ধরে বাগেরহাট অঞ্চলে পিঠাটির প্রচলন থাকায় এই জেলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সেমাই পিঠা। একসময় শুধু বাগেরহাটের মানুষের কাছে পরিচিত এ পিঠা এখন বিভিন্ন জেলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। 

এই পিঠা তৈরির জন্য প্রথমে আতপ চালের গুঁড়া ফুটানো পানিতে সেদ্ধ করে মণ্ড তৈরি করা হয়। এরপর পিতলের মেশিনে দিয়ে হাতে ঘুরিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করতে হয় এই পিঠা। আগে মানুষ কাঠে তৈরি ঢেকিকল দিয়ে চাপ দিয়ে এই পিঠা বানাতো। এখনকার যুগে ঢেকিকল প্রায় বিলুপ্ত। বাজার থেকে কেনা পিতলের তৈরি মেশিনের প্রচলনই বেশি। পিঠা তৈরির পর খাওয়ার উপযোগী করতে সেগুলো আবার গরম পানির ভাপে ভাপা পিঠার মত সিদ্ধ করতে হয়। 

SEMAI-PITHA-এ পিঠা তৈরি করতে তিন থেকে চারজন সদস্যের প্রয়োজন হয়। তাই এ পিঠা তৈরির সময় বাড়িতে রীতিমতো ছোটোখাটো একটি উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়। চাহিদা থাকায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁতেও বর্তমানে শেয়াই পিঠা বিক্রি করা হয়।


বিজ্ঞাপন


বাগেরহাট জেলা শহরের জোসনা বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে অতিথি আসলেই দুপুরে অথবা রাতে শেয়াই পিঠার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা পরিবারের সবাই মিলে এ পিঠা তৈরি করি। একজন চালের গুঁড়া সেদ্ধ করে, একজন গুঁড়ার মণ্ড তৈরি করে কলের ভিতর দেয়, আরেকজন কল ঘোরায়, কলের নিচ থেকে বের হওয়া পিঠা নিয়ে আরেকজন সেটা ভাপের ব্যবস্থা করে। শেয়াই পিঠা খেতে যেমন মজার তেমন সবার অংশগ্রহণে এ পিঠা তৈরি করাও খুব আনন্দের। বিভিন্ন উৎসবে শেয়াই পিঠা আর হাঁসের মাংস ছাড়া আমাদের চলেই না।

নাগের বাজার এলাকার সোহাগ আহমেদ বলেন, শেয়াই পিঠা আমাদের বাগেরহাট অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। তাই নতুন চাকরি পাওয়ার পর সহকর্মীদের নিয়ে শেয়াই পিঠা খাওয়ার আয়োজন করেছিলাম। সবাই এ পিঠা খেয়ে প্রশংসা করেছে। অন্য জেলার মানুষের কাছেও আমাদের ঐতিহ্যবাহী এ পিঠা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শেয়াই পিঠা খাওয়ার পর ঢাকায় থাকা আমার বন্ধু বাগেরহাট থেকে পিঠা তৈরির কল সংগ্রহ করেছে। তারাও এখন শেয়াই পিঠা তৈরি করে। 

দশানী এলাকার সায়েরী আক্তার বলেন, আমাদের বাগেরহাটের মানুষ শেয়াই পিঠা খুব বেশি পছন্দ করে। ভাপ থেকে তোলা গরম পিঠায় হাঁসের মাংসের ঝোল ঢেলে খাওয়া আমাদের স্থানীয় ঐতিহ্য। নতুন জামাই ও অতিথিদের আপ্যায়নে আমরা শেয়াই পিঠার আয়োজন করে থাকি। যেকোনও অনুষ্ঠানে খাবারের মেনুতে শেয়াই পিঠা রাখা হয়। এবার শীতেও আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার শেয়াই পিঠার আয়োজন করা হয়েছিলো। 

পিঠার কল বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, বর্তমানে অনলাইনের জন্য অনেকেই এ পিঠা সম্পর্কে জেনেছে ফলে আগের তুলনায় কল বিক্রি বেড়েছে। অনেকেই এখন শেয়াই পিঠা তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ কাঠের ও পিতলের কল কিনতে আসে। শীত এলে আমাদের বিক্রি বেড়ে যায়। তিনি জানান, পিতলের তৈরি পিঠার কলের দাম রকমভেদে ৯০০ থেকে ২০০০ টাকা এবং কাঠের তৈরি কলের দাম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর