সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বগুড়ার নিভৃত গ্রামে শতকোটি টাকার বাড়ি

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ১৮ নভেম্বর ২০২২, ১১:৪১ এএম

শেয়ার করুন:

বগুড়ার নিভৃত গ্রামে শতকোটি টাকার বাড়ি
ছবি : ঢাকা মেইল

দেউলী সরকারপাড়া। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এ গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি টিনের তৈরি। আঁকাবাকা মেঠোপথ দিয়ে যেতেই হঠাৎ চোখ পড়ে বিশাল দুটি অট্টালিকার দিকে। শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি অট্টালিকা দুটি দৃষ্টি কাড়ে সবার। দূর থেকে দেখে মনে হয় রাজপ্রাসাদ। এলাকায় টুটুলের বাড়ি নামে চেনে সবাই। কারো কারোর কাছে টুটুলের ৫ শত কোটি টাকার বাড়ি নামে পরিচিত।

এই বাড়িটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। আর সময় লেগেছে ১২ বছর। এখন এখানে কেউ বসবাস করে না। দেখাশোনা করার জন্য ২-৩ জন কেয়ারটেকার রয়েছেন। 


বিজ্ঞাপন


bogura

জেলা শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নিভৃত গ্রাম দেউলী সরকারপাড়া। মহাস্থান মোকামতলা হয়ে কিছুটা এগিয়ে পাকুরতলা এলাকায় পৌঁছে ডান দিকে ঘুরে কয়েক কিলোমিটার আকাঁবাকাঁ পথ পেরোলে দৃষ্টিতে আসবে রাজ প্রাসাদের মতো বাড়িটি। শিবগঞ্জের মাটিতে পা দিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেই সবাই দেখিয়ে দেয় এ রাজপ্রাসাদ। 

বাড়ির পুরো সীমানাসহ প্রতিটি অবকাঠামো দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। বাড়িটির  মূল ফটকটি নাটোরের উত্তরা গণভবনের নকশার আদলে তৈরি। ভেতরে চারতলা ভবনের প্রথম ইউনিট ও দ্বিতীয় ইউনিটের ওপর চৌকোনা চারটি গম্বুজ রয়েছে। 

>> আরও পড়ুন : বাঘের কারণে বিধবা ওরা, শুনতে হয় ‘অপয়া’ গালি


বিজ্ঞাপন


মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পরই হাতের বাঁয়ে চোখে পড়বে শ্বেতপাথরের হংস ফোয়ারার চার ধারে পাথরের শান বাঁধানো পুকুর। বাড়ির প্রথম ইউনিটে বড় দরজা দিয়ে প্রবেশের পর বিশাল হলরুম। দেয়ালের পরতে পরতে নকশা। দ্বিতীয় ইউনিটে ঢুকতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় নজরে আসবে পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা)। প্রতিটি ফলকে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

bogura

দোতলার ঘরগুলো সুপরিসর। এখানে ফাইভ স্টার হোটেলের লাউঞ্জ ও রিসিপশনের মতো ডিজাইন করে রাখা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে চতুর্থ তলায় গিয়ে মনে হবে, বিদেশি হোটেলগুলোর মতো। 

কাঠের জানালা-দরোজাসহ প্রতিটি কাজই প্রাচীন নকশায় তৈরি। দামি কাঠ ব্যবহার হয়েছে এসব কাজে। শ্বেতপাথরও আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। প্রতিটি ঘরেই এয়ারকন্ডিশনার আছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ২০০৬ সালে হঠাৎ করে টুটুল তার বাবার টিনের বাড়ির পাশে প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গা নিয়ে শুরু করেন এই বাড়ি নির্মাণের কাজ। শুরুতে প্রতিবেশীরা মনে করেছিল, মাঝেমধ্যে গ্রামে এসে অবস্থান করার জন্য তিনি সাদামাটা বাড়ি তৈরি করছেন। কিন্তু দেখা যায়, ইটের পরিবর্তে কংক্রিটের গাঁথুনি দিয়ে শুরু করা হয় নির্মাণকাজ। পাশাপাশি দুটি ভবন তৈরি করা হয়। 

নির্মাণ শেষে বাড়ি দুটি ও সীমানাপ্রাচীরে টাইলসের পরিবর্তে শ্বেতপাথর দেওয়া হয়। এমনকি সেপটিক ট্যাংকের ওপরের অংশেও দেওয়া হয়েছে শ্বেতপাথর। নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরাও এলাকার কেউ নয়। 

bogura

দীর্ঘ ১২ বছর ধরে নির্মাণকাজ শেষে ২০১৮ সালে বসবাসের উপযোগী হয় বাড়ি দুটি।

একটি চারতলা আরেকটি তিনতলা বাড়ির ছাদে রয়েছে চারটি করে গম্বুজ। প্রধান ফটকে রয়েছে চারটি গম্বুজ। দুটি বাড়ি ছাড়াও আলাদা করে রয়েছে দুটি পুকুর, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর ভাস্কর্য নিয়ে তৈরি করা একটি পার্ক ও ফুলের বাগান।

বাড়ির মালিক সাখাওয়াত হোসেন টুটুল দুদকের মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। বর্তমানে জামিনে আছেন। একটি ব্যাংকের ঋণখেলাপির মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার মতিঝিল থানার ওই মামলা দায়ের করা হয়।  

>> আরও পড়ুন : যানজটের শহর নওগাঁ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টুটুল রূপালী ব্যাংক ঢাকার দিলকুশা শাখা থেকে ৯৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।

ওই গ্রামের হাসেম বলেন, টুটুল জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তবে তিনি দেশে না, বিদেশে আছেন তা জানা নেই। তার পরিবারের লোকজন মাঝেমধ্যে আসে গ্রামে। 

bogura

দেউলী সরকারপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে টুটুল। স্কুলজীবনে মা-বাবার ওপর অভিমান করে বাড়ি ছাড়েন টুটুল। এরপর ঢাকায় থাকা শুরু করেন। সেখানেই লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেন এক বিদেশি  নারীকে। তারপর হঠাৎ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় টুটুলের। ভাগ্যের বিশাল পরিবর্তন ঘটে টুটুলের।  ঢাকার ধানমণ্ডিতে একটি স্কুল, গাজীপুর টাটকা ফুড প্রডাকশন ফ্যাক্টরি, গ্রামের বাড়িতে একটি ইটভাটা এবং একটি কোল্ড স্টোরেজ ছাড়াও শতাধিক বিঘা আবাদি জমি রয়েছে টুটুলের। এছাড়া আরো অনেক ব্যবসা রয়েছে তার। 

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান টুটুল কিভাবে এত সম্পত্তির মালিক হলেন, তা নিয়ে এলাকার লোকজনের মধ্যে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। আলোচনা-সমালোচনা যাই থাকুক ভয়ে মুখ খুলতে চান না কেউ। 

বাড়ির মালিক টুটুল সপরিবারে ঢাকায় থাকেন।

একসময় প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসতো বাড়িটি দেখার জন্য। কিন্তু বাড়ির মালিক গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

bogura

কেয়ারটেকার বাবলু জানান, অপরিচিত লোকজনকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতে কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে। এদিকে লোকজনের ভিড় হওয়ার কারণে বাড়ির সামনে গড়ে উঠেছে একটি হোটেলসহ কয়েকটি দোকান। পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন।

>> আরও পড়ুন : ঘোড়ার গাড়ি যেখানে ভরসা

সাখাওয়াত টুটুল জেলহাজতে থাকার পর থেকে তার বড় ভাই ফজলুল বারি তার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করছেন। ফজলুল বারি জানান, তিনি আসলে এসব ব্যাপারে কথা বলতে চান না। টুটুল কেন এত টাকা খরচ করে এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন তাও পরিষ্কার নয়। তবে এটা ঠিক যে এই বাড়ির কারণেই তাকে জেল খাটতে হচ্ছে।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর