মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বাঘের কারণে বিধবা ওরা, শুনতে হয় ‘অপয়া’ গালি

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২২, ১২:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

বাঘের কারণে বিধবা ওরা, শুনতে হয় ‘অপয়া’ গালি
ছবি : ঢাকা মেইল

রাশিদা বেগম। বয়স ৫০। সুন্দরবন সংলগ্ন চকবারা গ্রামে থাকেন তিনি। স্বামী আলম গাজী সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যান। রাশিদা-আলমের সংসার চলতো মধু বিক্রি করে। আলম মধু সংগ্রহ করে প্রতিদিন দুপুরের আগে বাড়ি আসতেন। চার সন্তান নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। রাশিদা বললেন, স্বামী মদ্যি মদ্যি বলত, বাঘ দেখলি ভয় করে না, বাঘ আমারে খাবে না।

৮-১০ বছর আগে একদিন। স্বামী বাড়ি ফেরেননি। মুহূর্তে সারা গ্রাম রটে গেল, আলম গাজী কাল জঙ্গল করতে গিয়ে আজও ফেরেননি। গ্রামের মানুষ বনে ছুটলেন। দেখলেন, বাঘের পায়ের চিহ্ন, আর ছোপ ছোপ রক্ত। বিধবা হলেন রাশিদা বেগম। এরপর থেকে স্বামীর রেখে যাওয়া কয়েক শতক জমির ভিটাবাড়িতে কোনোরকম সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন।


বিজ্ঞাপন


এমন দুরবস্থার মধ্যেও তিনি আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি।

একই গ্রামের বাঘবিধবা নারী মুর্শিদা বেগম (৩৭)। তিনি জানান, গত দুই বছর আগে সুন্দরবনে বাঘের হাতে নিহত হয় স্বামী রেজাউল ইসলাম। ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে ক্ষেত মজুরের কাজ করে জীবনযাপন করছেন তিনি। 

মুর্শিদা জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর যে মানসিক কষ্ট পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন সমাজের বঞ্চনা থেকে।


বিজ্ঞাপন


তিনি বলেন, স্বামীর স্বজনদের বাড়ি গেলে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কথাও বলতে চায় না। আমার কারণে নাকি বাঘে ধরেছে স্বামী রেজাউলকে। এরকম নানা ধরনের কুসংস্কার ও সামাজিক বঞ্চনা মাথায় নিয়ে দিন কাটছে। তবে শুনেছি বৈধ পাসধারী কোনো বনজীবী বাঘের আক্রমণে মারা গেলে সরকার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন। কিন্ত আমি এখন পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ পাইনি।

গত ১০ বছরে জীবিকার সন্ধানে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলের সহস্রাধিক বনজীবী মানুষ। সম্প্রতি বাঘের হামলায় প্রাণ হারানোর সংখ্যা কমলেও একসময় প্রায়ই সুন্দরবনে এমন খবর পাওয়া যেত। বাঘের হামলায় প্রাণ হারানোকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে মেনে নেয় না সাধারণ মানুষ। ফলে বাঘ-বিধবা অপবাদ নিয়ে তাদের স্ত্রীদের সারাজীবন বেঁচে থাকতে হয়। এসব বাঘ-বিধবা নারী সাংসারিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত তাদের শুনতে হচ্ছে অপয়া, অলক্ষ্মী, ডাইনি ইত্যাদি নিপীড়নমূলক শব্দ।

স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের অ্যাভোকেসি কর্মকর্তা পরিতোষ কুমার জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলা সাতক্ষীরা শ্যামনগর ও খুলনার কয়রা এলাকার বাঘ-বিধবাদের নিয়ে কাজ করছে তার সংস্থা। লিডার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও পাশের কয়রা উপজেলাতেই ১ হাজার ১০০ জন বাঘ-বিধবা নারী রয়েছেন। এর মধ্যে ৩০০ জন বাঘ-বিধবা নারীর সহায়তায় কাজ করছে লিডার্স। এছাড়া শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ও গাবুরা ইউনিয়নে ১২০ এবং কয়রার বেতকাশি ইউনিয়নে ১৮০ জন।

পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন সুন্দরবনের বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় সাতক্ষীরার উপকূলের লক্ষাধিক মানুষের। প্রতি বছর মৌসুমে বন বিভাগ থেকে বৈধ পাশ নিয়ে গোলপাতা কাটা, মধু আহরণ, নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরাসহ বিভিন্ন কাজে যেত বনজীবীরা। অনেকে পাশ ছাড়াও অবৈধভাবে সুন্দরবনে গিয়ে মধু আহরণসহ নদীতে মাছ ধরার কাজ করত। ফলে এক সময় বনজীবী এসব মানুষের ওপর বাঘের আক্রমণও ছিল অনেক বেশি। 

কয়েক বছর আগেও প্রায়ই বাঘের আক্রমণে জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত। বাঘের আক্রমণে দাদা, বাবা ও ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে এমন খবরও পাওয়া যেত। 

সম্প্রতি সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমেছে। তবে ভালো নেই উপকূলে বাঘের হামলায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্ত্রী বাঘ-বিধবারা। অভাব-অনটন আর সমাজের নানা বঞ্চনা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের।

খোঁজ নিয়ে যানা যায়, সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় এক হাজারেরও বেশি বাঘ-বিধবা নারী রয়েছে। অভাব-অনটন আর সামাজিক বঞ্চনা নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ বাঘ-বিধবা নারী। এসব বাঘ-বিধবা নারীরা সাংসারিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন সমাজ থেকে। প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে তাদের অপায়া, অলক্ষ্মী, ডাইনি ইত্যাদি নামে।

রাশিদা বেগম আর মুর্শিদা বেগমের মতো একই কষ্টের বর্ণনা দিলেন, সুন্দরবন লাগোয়া খলশিবুনিয়া গ্রাামের বাঘ বিধবা নারী রহিমা বেগম, পার্শ্বেমারী গ্রামের সুখজান বিবি, গাবুরা গ্রামের খাদিজা খাতুন ও ৯ নম্বর সোরা গ্রামের আনোয়ারা বেগম। এসব বঞ্চনার শিকার বাঘ বিধবা নারীরা পুনর্বাসনে সরকারের সাহায্য চান। তাদের মতো সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের শ্যামনগর উপজেলাতেই ৫ শতাধিক বাঘ-বিধবা নারী মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী জানান, বৈধ পাস নিয়ে সুন্দরবনে যদি কোনো মৌয়াল, জেলে বা বাওয়ালি বাঘের আক্রমণে নিহত হন, তাহলে সরকার তাকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। একই সঙ্গে কেউ আহত হলে তাকেও ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত বিধিমালা ২০২১ এর অধীনে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন সরকার। তবে এর আগে সরকারি সাহায্যের পরিমাণ ছিল কম। সরকারি আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি যে সমস্ত বাঘ-বিধবা নারী রয়েছে তাদের বিনামূল্যে পাস দেওয়া হচ্ছে। তারা যেন নদীতে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে অন্তত কিছু উপার্জন করে সংসার নির্বাহ করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, অবৈধ উপায়ে যারা সুন্দরবনে মধু আহরণ বা মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয় তারা সরকারের এই সহায়তা পাবে না। আর যারা অবৈধভাবে বনে প্রবেশ করে বন্যপ্রাণীদের হাতে নিহত হয় সরকারিভাবে সে সব মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে বুড়িগোয়ালী রেঞ্জের অধীনে সরকারিভাবে বাঘের আক্রমণে নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান তিনি দিতে পারেননি।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ হুমায়ুন কবির জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার যে সমস্ত অসহায় বাঘ-বিধবা নারী রয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পুনর্বাসনের জন্য জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর