বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

গোবর কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই চিন্তা থেকে বদলে গেল রেশমার জীবন

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:২৪ এএম

শেয়ার করুন:

গোবর কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই চিন্তা থেকে বদলে গেল রেশমার জীবন

বগুড়ায় কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদনে সফল হয়েছেন রেশমা নামের এক কৃষানি। তিনি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের বোংগা গ্রামের পরিবার পরিকল্পনা সহকারী হোসনে আরা বেগমের মেয়ে। 

রেশমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার সংগ্রামী জীবনের কথা। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠেন রেশমা। বয়স যখন ২ মাস, তখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং এরপর থেকেই তার বাবা-মায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক সময় তা বিচ্ছেদে রূপ নেয়। ৫ বছর বয়সী রেশমাকে নিয়ে তার মা চলে আসেন বাবার বাড়িতে। নিদারুণ অভাব অনটনের সংসারের হাল ধরতে রেশমার মা মাঠকর্মী হিসেবে যোগদান করেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে। বেতন সর্বমোট ১৫০০ টাকা। রেশমার বাবা তাদের কোনো খবর রাখতেন না। মায়ের পরিশ্রমেই বেড়ে ওঠেন তিনি। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। অনেক কষ্টে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতে সক্ষম হন রেশমা।


বিজ্ঞাপন


মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় রেশমাকে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! পিতৃস্নেহ বঞ্চিত রেশমার স্বামীও আর দশজনের মত ছিল না। মাদক ও জুয়া তার নিত্য সঙ্গী। মায়ের কাছ থেকে  টাকা আনার জন্য নির্যাতন চালাতো রেশমার উপর। বাধ্য হয়েই স্বামী তালাক দিয়ে মায়ের কাছে চলে আসেন রেশমা। এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। নিজ প্রচেষ্টায় পরিশ্রম, ধৈর্য এবং সততায় এখন সেই দিন পাল্টে গেছে তার। 

বাড়িতে কেঁচো সার তৈরি করে বিক্রির মাধ্যমে রেশমা নিজেই নিজের সংসারের হাল ধরেছেন। সখের বসে ২০১৬ সালে দুইটি গরু পালন শুরু করেন তিনি। সেই গরুর গোবর কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তায় থেকে ২০১৭ সালে মাত্র ৩টি সিমেন্টের রিং-এ কেঁচো সার উৎপাদনের মাধ্যমে জীবনযুদ্ধের পথচলা শুরু করেন রেশমা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। 

>> আরও পড়ুন: ঠাকুরগাঁওয়ে কেঁচো সার বানিয়ে কৃষাণীদের লাখ টাকা আয়

এখন তার খামারে ৬৫টি পাকা চৌবাচ্চা, ১৩৫টি রিং এবং ২০০টি ক্যারেটে কেঁচো সার তৈরি হচ্ছে। উৎপাদিত সার ও কেঁচো বিক্রি করে মাসে প্রায় ২ লক্ষ টাকার উপরে আয় করেন রেশমা। বর্তমানে খামারে প্রতি মাসে প্রায় ২০-২২ মে. টন কেঁচো সার ও ৮-১০ মে. টন ট্রাইকোকম্পোস্ট উৎপাদন হয়। এই সার ব্যবহার করে একদিকে যেমন মাটির স্বাস্থ্য উন্নত হচ্ছে, রাসায়নিক সারের উপর চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকরা বিভিন্নভাবে লাভবান হচ্ছেন। এদিকে রেশমা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে ৫-২০ জন নারীর। 

রেশমা বলেন, বর্তমানে আমার খামার থেকে উৎপাদিত জৈব সার অনলাইন ও অফলাইন অর্ডারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের কাছে চলে যাচ্ছে। দিন দিন ভার্মিকম্পোস্টের চাহিদাও বাড়ছে।  সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে আমার মতো খামারিরা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারবে। 


বিজ্ঞাপন


ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন ছাড়াও তিনি তার বাড়ির আশপাশে সুপারি, পেঁপে ও বিভিন্ন শাক সবজি-সবজির চাষ করছেন। গরু, হাঁস মুরগী ও কবুতর লালন পালন, পুকুরে মৎস্য চাষ, ব্লাক সোলজার পালন করে এখন বদলে গেছে তার সংসার। 

উদ্যোক্তা সুরাইয়া ফারহানা রেশমা জানান, বাবার অভাবের সংসার থেকে স্বামীর সংসার পর্যন্ত কখনও সুখ ও স্বচ্ছলতা নামক সোনার হরিনটির দেখা পাননি তিনি। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পরই রেশমা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন  নিজে কিছু করবেন। অন্যের পরিচয়ে নয় নিজের পরিচয়ে বড় হবার অদম্য ইচ্ছে ছিলো যা দিয়ে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরানো যায়।  ভাবনা থেকেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই কেঁচো সার উৎপাদন শুরু রেশমা।  বাড়িতেই এ কাজ শুরু করেন তিনি।

রেশমা চেয়েছিলেন নিজের পাশাপাশি কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করবেন তিনি। কৃষকরা যেভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে তাতে মাটির স্বাস্থ্য মারাত্ত্বক হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। তাছাড়া মায়ের কাছে শোনা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কুফল তাকে এ কাজে অনুপ্রাণিত করে। রাসায়নিক সার অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাছাড়া রাসায়নিক সার দিয়ে উৎপাদিত ফসল খেয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত নানান জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রাসায়নিক সার জমিতে মাত্রা অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাভাবিক স্বাস্থ্য নষ্ট হয়।

>> আরও পড়ুন: এমবিএ পাস সজীব বানাচ্ছেন জৈব সার

জানা যায়, তার কেঁচো সার উৎপাদন দেখে প্রথমে এগিয়ে আসে টিএমএসএস। কেজিএফ এর আওতায় তারা রেশমাকে প্রথমে তার খামার বাড়াতে সহযোগীতা করে। শুরু হয় নতুন করে পথ চলা। এর পর তিনি তিনি যুব উন্নয়ন অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতর, প্রাণি সম্পদ অধিদফতর ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমি থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। 

রেশমা বলেন, এই সার ব্যবহারে উৎপাদিত ফসল আমি নিজেও খাচ্ছি এবং এলাকার সকল কৃষক যাতে ব্যবহার করে সে বিষয়ে চেষ্টাচালিয়ে যাচ্ছি। এ কাজে আমি সরকারের পাশাপাশি সর্ব সাধারণের সহযোগিতা কামনা করছি। আমি বেকার যুবক ও নারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই সততা, ইচ্ছে এবং সাহস থাকলে পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সময়ের ব্যপার। আমি অসহায় নারীদের বলছি, আপনারা চেষ্টা করুন। আমরা নারী, আমরাও পারি। আমরা পিছিয়ে থাকবো না। আমরা সমাজে অবহেলিত হয়ে নুয়ে পড়বো না।

শেরপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুবির কুমার পাল বলেন, ‘আমি সুরাইয়া ফারহানা রেশমার কৃষি কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিজে দেখেছি। রেশমার সংগ্রামী চেষ্টায় শূন্য থেকে সফলতা অর্জন দেশের কৃষক ও কৃষাণীদের জন্য অবশ্যই অনুকরণীয়। যখন দেশের অগণিত কৃষক কৃষি কাজে মাত্রা অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করে জমির উর্বরতা নষ্ট করছে তখন রেশমা জৈব সার তৈরি এবং জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

প্রতিনিধি/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর