শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শত বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে আন্দোলনে তারা

পুলক পুরকায়স্থ
প্রকাশিত: ১৩ আগস্ট ২০২২, ০৮:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

শত বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে আন্দোলনে তারা
অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছেন চা শ্রমিকরা। ছবি: ঢাকা মেইল

যাদের শ্রমে-ঘামে ঘুরে চা শিল্পের চাকা, সেই শ্রমিকরা আজ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শত বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে শ্রমের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করছেন অবহেলিত সবুজ শিল্পের চা শ্রমিকেরা। দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে শনিবার (১৩ আগস্ট) সকাল থেকে শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট।

চা শ্রমিকরা আক্ষেপ করে জানান, চা শিল্পের উন্নতি হলেও বদলাচ্ছে না তাদের জীবন। সারাদিন কাজের পর একেকজনের আয় হয় ১২০ টাকা। নেই নিজস্ব জাতিগত পরিচয়, লেখাপড়ার সুযোগ, নেই স্যানিটেশনও, রয়েছে চিকিৎসার অভাব। প্রতিদিন তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করে তৈরি করা সম্পদ নিজেদের জীবনে কাজে না লাগলেও তাতে প্রতিদিন ফুলে ফেঁপে ওঠে অন্যের ধনভাণ্ডার।


বিজ্ঞাপন


জানা গেছে, চা বাগান কর্তৃপক্ষের বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক, বাড়ছে না চা শ্রমিকদের জীবনমান। আধুনিক জীবনযাপনে চা শিল্পে জড়িত জনগোষ্ঠী সচেতন নন। আত্মউন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা থেকে এরা বঞ্চিত। যেহেতু এদের কর্মস্থলে বাস করা বাধ্যতামূলক, তাই মালিক পক্ষের দেওয়া ১০ বা ১২ ফুটের ঘরে তারা বাস করেন। তাদের নেই নিজস্ব আবাদি জমিও। তারা সবসময়ই দরিদ্র জীবনযাপন করে, সঙ্গে থাকে নিত্যদিনের দুর্ভিক্ষ। একজনের মজুরি দিয়ে সংসার চলে না, তাই স্বামী ও সন্তানসহ কাজ করে থাকেন। বর্তমানে তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এছাড়া বেকার ও ছাঁটাই শ্রমিকদের অবস্থা আরও কষ্টকর। কাজের সুযোগ না থাকা, লেখাপড়া না জানা, গৃহহীনতা, সঞ্চয় করতে না পারা, রয়েছে পুষ্টিকর খাবারের অভাব।

tea2

নারী চা-শ্রমিক রমা গোয়ালা বলেন, ‘কত কষ্ট করে কাজ করি, কিন্তু আমাদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয় না। বাড়িতে শাশুড়ি, স্বামী, এক ছেলে, দুই মেয়ে রয়েছে। আমার একার রুজি দিয়ে সংসার চালাই। তিন কেজি আটা পাই রেশনে। চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য জিনিস কিনতে হয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ আছে। অসুখ হলে চিকিৎসা করাতে হয়। প্রতিদিনই জিনিসের দাম বাড়ছে, কিন্তু মজুরি তো বাড়ছে না। মজুরি না বাড়লে কাজ করব না।’


বিজ্ঞাপন


চা শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্রমতে, বর্তমানে সারাদেশে ১৬৭টি চা বাগানে চা জনগোষ্ঠী পাঁচ লক্ষাধিক। এরমধ্যে শ্রমিক রয়েছেন এক লাখ ৪০ হাজার ১৬৪ জন। সিলেট বিভাগের তিনটি জেলায় ১৩৫টি চা বাগানে রয়েছেন ৪৬ হাজার ৪৫০ জন নিবন্ধিত মহিলা শ্রমিক এবং ১৫ হাজার ১৫৩ জন অনিবন্ধিত মহিলা শ্রমিক।

আরও পড়ুন: চা শ্রমিক: বিভীষিকার কালো গহ্বরে বন্দি যাদের জীবন

চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছেন এস এম শুভ। তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, বর্তমানে চা বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশে চা রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। পাঁচ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রমে সচল হয় দেশের অর্থনীতি। চা শ্রমিকরা যে মজুরি পান এতে তাদের পুষ্টির ন্যূনতম চাহিদাও পূরণ হয় না। কর্মক্ষেত্রে বিশ্রাম, পানীয় জল ও স্বাস্থ্যকর সেনিটেশনের অভাবে শ্রমিকরা আছেন চূড়ান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। শ্রমিকদের বড় অংশই ভোগেন রক্তশূন্যতায়। চা শ্রমিকদের ৬৪ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাদের অবস্থা আরও করুণ।

tea3

দেওরাছড়া চা বাগানের চা শ্রমিক ব্রিটিশ ঘাটুয়াল ঢাকা মেইলকে বলেন, 'বাগানে ছোট ভাঙাচোরা ঘরে থাকতে হয় গবাদি পশুসহ সন্তানদের নিয়ে। বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না বছরের পর বছর। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গাও হারাতে হবে।'

বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের সভাপতি বিশ্বজিৎ কৈরী ঢাকা মেইলকে বলেন, '২০২০ সালের চুক্তি অনুসারে একজন শ্রমিককে অবসর ভাতা হিসেবে সে যত বছর কাজ করেছে তার মোট বছরের গড়ে দেড় মাসের বেতন হিসেবে পেনশন দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা শুধু কাগজে কলমে।'

আরও পড়ুন: মজুরি বৈষম্যের শিকার শান্তি-রেহেনার মতো হাজারো চা-পাথর শ্রমিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, চা জনগোষ্ঠীর সদস্য সন্তোষ রবিদাশ বলেন, আমরা আমাদের অধিকারের জন্য লড়ছি। আমরা আগের চেয়ে আরও বঞ্চিত হচ্ছি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে। আমাদের নেই কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। চা-শ্রমিকের সন্তান হিসেবে আমরা এখনও অনেকভাবে সমতলের মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠীর কাছে অপদস্ত হতে হয়।

tea4

চা জনগোষ্ঠী এখনও ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি জানিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু ধলাই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি ঢাকা মেইলকে বলেন, 'চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি আমাদের জীবনযাত্রায়। এমনকি মৌলিক অধিকারও ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না।'

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমরা এই স্বাধীন দেশে উপেক্ষিত হয়ে আছি। আমাদের ভোটে সংসদ সদস্য হন, এমপি, মন্ত্রী হন, কিন্ত আমাদের পক্ষে কথা বলার লোক নেই। আমরা অসহায়।'

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর