শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঠাকুরগাঁও হাসপাতাল নিজেই ‘রোগী’! নোংরা পরিবেশ ও জনবল সংকটে বেহাল দশা

মো. জাহিদ হাসান মিলু, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

ঠাকুরগাঁও হাসপাতাল নিজেই ‘রোগী’! নোংরা পরিবেশ ও জনবল সংকটে বেহাল দশা

ঠাকুরগাঁওয়ের ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল— উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁওসহ আশপাশে দুই জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষের চিকিৎসার প্রধান ভরসাস্থল। কিন্তু যে স্থানে মানুষ আসে সুস্থতার আশায়, সেই স্থানই এখন যেন রোগ উৎপত্তির কেন্দ্রস্থল। নোংরা- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হাসপাতালটি।

রোগীরা বলছেন, এখন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে মানুষ সুস্থ নয়, বরং আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধারণক্ষমতার দুই থেকে তিন গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, জনবল সংকট ও অব্যবস্থাপনার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে স্থানীয় সচেতন নাগরিক ও সেবাগ্রহীতারা মনে করছেন— ঠাকুরগাঁওয়ে দ্রুত একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন ছাড়া স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের বিকল্প নেই।


বিজ্ঞাপন


Photo_(4)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

সরেজমিনে দেখা যায়, ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের ধারণক্ষমতা ২৫০ শয্যা হলেও প্রতিদিন ভর্তি থাকে প্রায় ছয়শ থেকে সাতশ রোগী। রোগীর চাপে বেড তো পাওয়া যায় না, অনেক সময় ফ্লোরেও জায়গা মেলে না। চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় ডাক্তার ও নার্সদের।

Photo_(8)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

অন্যদিকে হাসপাতালের করিডোর, বাথরুম এমনকি রোগী ওয়ার্ড— সবখানেই নোংরা পরিবেশ। নোংরা অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সুস্থ মানুষও সেখানে প্রবেশ করলে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে দু’টি লিফটের মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে চাপের ভিড়ে গুরুতর রোগী বা বয়স্কদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় তীব্র কষ্টের মধ্যে। দীর্ঘদিন ঘরে বালতি ও পাত্রে জমে থাকা নোংরা পানি। যেখান থেকে জন্ম নিতে পারে এডিস মশাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ। এছাড়াও হাসপাতালের ভেতরে কুকুরের বিচরণ তো আছেই। যার মাধ্যমে ছড়াতে পারে জলাতঙ্ক রোগ। এমনকি আইসিইউ, ডায়ালাইসিস ইউনিট এবং পিসিআর ল্যাবের জন্য নির্ধারিত ভবন ও স্থান থাকলেও, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল না থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই সেগুলো চালু হয়নি।


বিজ্ঞাপন


Photo_(9)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ— এই হাসপাতালে অধিকাংশ পরীক্ষার রিপোর্ট বাইরে থেকে করাতে হয়। যেসব ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়ার কথা সেসব ওষুধ নিতে রোগীদের ছুটতে হয় বাইরের ফার্মেসিতে। আর অনেক রোগীকে দিনাজপুর, রংপুর বা ঢাকায় রের্ফাড করেন। এতে নিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই মৃত্যুর মুখে পতিত হন। এছাড়া এখানে ডাক্তার পাওয়া যায় না ঠিকমতো। বাথরুমগুলোতে ঢোকা যায় না। বেসিনগুলোতে হাত ধোয়ার অবস্থা নেই। এখানে রোগী নিয়ে আসলে সুস্থ মানুষ গুলোই আমরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি এমন অবস্থা এখানকার বলে জানান তারা।

Photo_(10)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

মো. মুজাহিদ বলেন, এখানকার পরিবেশ এতটাই নোংরা যে বলার মতো না। যেখানে সেখানে পানি ও ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকে। আর হাসপাতালে অনেকগুলো টেস্ট হয় না। রোগী নিয়ে টেস্ট করাতে বাইরে যেতে হয়। এভাবে আমরা চরম ভোগান্তিতে পরি। এছাড়া এখানে রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী সেবা দেওয়া মতো জনবল দেখছি না। জনবল বৃদ্ধি করলে হয়ত কিছুটা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাবে।

Photo_(11)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে অসুস্থতাজনিত কারণে মাকে নিয়ে হাসপাতালে দিয়েছেন মেহেদী হাসান। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, যেগুলো ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়ার কথা ওই ওষুধগুলো আবার আমাদের বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। তাহলে সরকার যে ওষুধ দিচ্ছে সেগুলো যাচ্ছে কোথায়। 

Photo_(14)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

শহীদুল ইসলাম উজ্জ্বল তার ছেলেকে নিয়ে ভর্তি আছেন হাসপাতালে। তিনি বলেন, ধরতে গেলে এই হাসপাতালে চিকিৎসা বলতে তেমন কিছুই হয় না। সময় মতো ডাক্তার পাওয়া যায় না। নার্সরা ঠিক মতো কথা শুনছেন না। তাদের কোনো কিছু বলতে গেলে বিরক্ত বোধ করেন। এছাড়া দীর্ঘদিন থেকে এখানকার লিফট নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এদিকে কেউ নজর দিচ্ছেন না। তাই আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়গুলো দেখার জন্য অনুরোধ করছি।

Photo_(15)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

রিক্তা পারভীন নামে এক মহিলা বলেন, হাসপাতালের বাথরুম টয়লেটের অবস্থা এতটাই খারাপ যে আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারছি না। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এসে বেসিনগুলোতে তাদের হাত ধুয়ে যে খাওয়াব সেটাও করতে পারি না এতটাই নোংরা। এখানে আমরা আসি সুস্থতার জন্য কিন্তু রোগীর সঙ্গে যারা আসি তারাই মনে হয় অসুস্থ হয়ে পড়ছি, এমন অবস্থা।

Photo_(21)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

বাঁধন নামে এক যুবক বলেন, এখানে রোগী নিয়ে আসলেই অধিকাংশ রোগীকেই শুধু রেফার করে দেওয়া হয় দিনাজপুর, রংপুরসহ ঢাকায়। অনেক ক্ষেত্রে এক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘ সময়ের রাস্তা হওয়ায় রোগীকে নিয়ে যেতে যেতেই অনেকের মৃত্যু হয়। এজন্য ঠাকুরগাঁওয়ে একটি ভালো মানের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল জরুরি হয়ে পড়েছে।

Photo_(22)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, এই হাসপাতালে প্রথম শ্রেণির চিকিৎসক ৫৯ জনের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৪০ জন। দ্বিতীয় শ্রেণির ৩টি পদেই শূন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সের পদ সংখ্যা মাত্র ৯১ জন। তার বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮৮ জন। তৃতীয় শ্রেণির পদ সংখ্যা ৪২ জন হলেও আছেন মাত্র ২০ জন। এখনও শূন্য পদ ২২টি। চতুর্থ শ্রেণির লোকবল ২৫ জনের বিপরীতে আছেন ১৭ জন। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে মঞ্জুরিকৃত মোট পদের সংখ্যা মাত্র ২২১টি। এর মধ্যে আবার এখনও শূন্য হয়ে পড়ে আছে ৫৬ জনের পদ।

Photo_(24)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. রকিবুল আলম (চয়ন) ঢাকা মেইলকে বলেন, রোগীর চাপ আমাদের সক্ষমতার অনেক বেশি। জনবল কম, আবার প্রায় তিনটি জেলার মানুষ চিকিৎসার জন্য আসেন। ২৫০ শয্যার অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় এই হাসপাতলে নার্সের সংখ্যা কম। তাই এক শিফটে ২০-২৫ জন নার্স দিয়ে ৬০০ থেকে ৭০০ রোগীর জন্য সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারপরেও সীমিত সম্পদে যতটা পারি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া যেসব রোগীদের ইউনিট এখানে চালু নেই ও আইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালাইসিস ইউনিট এবং পিসিআর ল্যাবের মতো রোগীদের রেফার করতে হয়। ভবিষ্যতে যদি এই ডিপার্টমেন্টগুলো এখানে চালু হয় তাহলে রেফারের সংখ্যা কমে আসবে।

Photo_(27)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

স্থানীয় সচেতন নাগরিক হিমেলসহ অনেকে বলেন, হাসপাতালটিতে আশপাশের কয়েকটি জেলার মানুষ সেবা নিতে ছুটে আসেন। তাই এখানে একটি মেডিকেল কলেজ না হলে মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া অসম্ভব। তাই ঠাকুরগাঁওয়ে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের দাবি জানান তারা।

thumbnail_Photo_(13)-Thakurgaon_Hospital_is_a_'patient'_itself!_Dirty_environment,_manpower_shortage_and_mismanagement_are_its_main_ailments

২৫০ শয্যার ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাল আজ রোগীদের আশ্রয়স্থল নয়, বরং দুর্ভোগের আরেক নাম। অবকাঠামো আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও জনবল এবং উন্নত সেবার অভাবে সবই যেন স্থবির। ঠাকুরগাঁওয়ে একটি আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল স্থাপনই হতে পারে এই দুরবস্থার একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর