দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়ায় গিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে বন্দুক যুদ্ধে নিহত নজরুল ইসলামের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়েছেন স্ত্রী আইরিন আক্তার।
নিহত নজরুল ইসলাম রাজবাড়ী জেলা সদর উপজেলার রামকান্তপুর চরপাড়া গ্রামের মৃত হাতেম আলী ফকিরের ছেলে। নজরুলের স্ত্রী ও চার কন্যা সন্তান আছে। তার বড় মেয়ে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। দ্বিতীয় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট দুই মেয়ের বয়স ৬ ও ৫ বছর।
বিজ্ঞাপন
নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী আইরিন আক্তার বলেন, গত ৩০ এপ্রিল স্বামীর সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। সেদিন তিনি টাকা পাঠানোর জন্য ব্যাংকে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করে জানান, টাকা পাঠানো হলো না, দ্রুত যেতে হচ্ছে। ফোনের ওপাশ থেকে স্বামী বলেন, আজকেই মনে হয় তোমাদের সঙ্গে আমার শেষ কথা। তোমাদের সঙ্গে মনে হয় আর দেখা হবে না। যদি ফোন বন্ধ পাও ধরে নিও আমি আর বেঁচে নেই। আমার চার মেয়েকে দেখে রেখো। তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে রেখে গেলাম, তিনিই তোমাদেরকে দেখবেন। সেটিই ছিল তার শেষ কথা। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
আইরিন আক্তার জানান, দীর্ঘ পাঁচ মাসের বেশি নিখোঁজ থাকার পর গত বুধবার (৮ অক্টোবর) বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার নম্বরে একটি ফোন আসে। তখন জানানো হয়, রাশিয়াতে বন্দুক যুদ্ধে তার স্বামী মারা গেছেন।
তিনি বলেন, আমার স্বামী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য ছিলেন। অবসরের পর যা টাকা পেয়েছিলেন, একটি ব্যবসায় লাগিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে যান। এরপর তিনি জমি বিক্রি করে ১৩ লাখ টাকা নিয়ে দালালের মাধ্যমে রাশিয়া চলে যান। এখন আমাদের অর্থকড়ি কিছুই নেই। পেনশনও আমার নামে করে দেননি।
বিজ্ঞাপন
তিনি সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, আমার স্বামীর মরদেহ দেশে ফিরিয়ে এনে দেওয়া হোক। এ ছাড়া, দালাল ফরিদ মণ্ডল ও জসিমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। আমার মতো আর ১০ জন নারীর জীবন যেন এমন না হয়, কারও সন্তান যেন বাবা হারা না হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি দেওয়ার কথা বলে দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়ায় যান রাজবাড়ী সদর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭)। কিন্তু সেখানে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি না দিয়ে তাকে রুশ সামরিক প্রশিক্ষণ করানো হয়। পরে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে তিনি প্রাণ হারান। পাঁচ মাস পর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো পরিবার।
নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন এবং ২০২০ সালে অবসরে যান। অবসরের পর বাড়িতে থাকার কিছুদিন পর রাজবাড়ীর শ্রীপুর বাজারে মুদি ব্যাবসা শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় ব্যবসায় বড় লোকসান হওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েন। এই অবস্থায় স্থানীয় এক দালাল ফরিদ হোসেন তাকে রাশিয়ায় শপিংমলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরির লোভ দেখায়। এরপর ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দালালের প্রলোভনে তিনি রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছানোর পর এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে তাকে বাধ্য করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় তাকে।
অভিযুক্ত দালাল ফরিদের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমি রাশিয়া পাঠাইনি নজরুলকে। সে গেছে বিকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে। আমি শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। সে সব জেনে-শুনেই গেছে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর লজিস্টিক হ্যান্ড হিসেবে। নো অবজেকশন সার্টিফিকেটে স্বাক্ষরও করে গেছে। আমি গত রাতে শুনেছি, মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে নজরুল মারা গেছেন। এখানে আমার দোষ দিয়ে লাভ কি।
আরও পড়ুন
রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মারিয়া হক বলেন, বিষয়টি আমি সাংবাদিকদের কাছ থেকেই জেনেছি। অফিসিয়ালি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়নি। এ বিষয়ে কোনো চিঠিও আমাদের কাছে আসেনি। তারপরও বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি এবং নজরুলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলছি।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি। এটা খুবই হৃদয়বিদারক ঘটনা। যার যায় সেই বোঝে আপন মানুষ হারানোর কষ্ট কতটা। আমরা শোকাহত পরিবারের পাশে থাকব। নজরুল ইসলাম যে রাশিয়াতে মারা গিয়েছেন, এ বিষয়ে আমরা কোনো চিঠি পাইনি। কিন্তু আমাদের দিক থেকে আমরা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।
প্রতিনিধি/এসএস

